২৮১! ১৭/৫! ১৭৫! ১৫৩! ৩৩৪! ৯৯.৯৪! – আমরা চাই বা না চাই, ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদয়ে কিছু সংখ্যা চিরকাল বিশেষ জায়গা দখল করে রাখে। এই সংখ্যাগুলি সেরকমই।
ধরা যাক ৩৩৪ সংখ্যাটা। অস্ট্রেলীয়দের কাছে সংখ্যাটি এতটাই শ্রদ্ধার যে বিশ্বরেকর্ডেরও হাতছানি উপক্ষা করে মার্ক টেলর নিজের ঐ স্কোরে ইনিংস ডিক্লেয়ার দিয়ে দেন। তাঁর কাছে স্যার ডনের পাশে নিজের নাম দেখার চেয়ে বেশি সম্মানের আর কিছু হতে পারে না।
খ্যাতনামা সেই গ্যাবা টেস্টের ঐতিহাসিক পঞ্চম দিনে ঋষভ পান্তের ব্যাটের মাধ্যমে ভারতের কাউন্টার অ্যাটাক বেশ কিছুক্ষণের জন্যে আমাদের এতটাই মোহিত করে রেখেছিল যে সম্মানজনক ড্র নয়, ভারতের জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা। পান্ত আউট হয়ে যাওয়ার পরই অবশ্য স্বপ্ন দেখা ছেড়ে বাস্তবের মুখোমুখি হলাম। আর সেই সঙ্গে আফসোস হল, ইশ! আরও অন্তত তিনটে রান করতে পারল না ছেলেটা!
কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম পন্থের ৯৭ তার ইনিংসকে ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসের এমন কিছু ইনিংসের পাশাপাশি স্থান দিয়েছে যার মুল্য বহু সেঞ্চুরি – ডাবল সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি। কোন এক অদ্ভুত কারণে ক্রিকেট দেবতা আমাদের ব্যাটধারীদের হিরে-মুক্তো দিয়ে সাজানো বেশ কিছু ইনিংস ৯৭ রানের মাথায় শেষ করে দেন। পন্থেরটা ধরে এই মুহূর্তে আমার মাথায় এমন চারটি ইনিংসের কথা আসছে। ক্রিকেটপ্রেমীরা যদি আরও কয়েকটা এই মাপের ৯৭ রানের ইনিংস খুঁজে পান তাহলে জানাতে ভুলবেন না।
সবচেয়ে প্রথমেই যে ইনিংসের নাম উঠবে সেটা হচ্ছে ১৯৭৫ সালে চিপকে শিল্পী ব্যাটসম্যান গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ৯৭। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে সেই সময় অ্যান্ডি রবার্টস নামের এক ভয়াবহ ফাস্ট বোলার। প্রানবন্ত উইকেটে প্রচণ্ড গতি, ভয়াবহ বাউন্সার আর মারাত্মক স্যুইঙ্গের মিশ্রণে প্রায় রবার্টস প্রায় একাই ভারতের প্রথম ইনিংসকে শেষ করে দিলেন ৬৪ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট নিয়ে।
তবু সেই টেস্ট রবার্টসের বোলিং নয়, স্মরণীয় হয়ে আছে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিশির খেলা অসাধারন এবং অপরাজিত ৯৭ রানের ইনিংসটির জন্যে। বিশ্বনাথের স্কয়ার কাট থামাতে একসময় নাকি দুটো থার্ডম্যান নিয়ে বল করতে বাধ্য হন রবার্টস। তা সত্বেও ভিশিকে থামানো যায় নি – সেই দুটো থার্ড ম্যানের মাঝখান দিয়ে বল বাউন্ডারিতে পাঠালেন তিনি। ম্যাচে রবার্টসের ১২ উইকেট সত্বেও মূলত বিশ্বনাথের শিল্পময় ব্যাটিং আর প্রসন্ন – বেদির মায়াবী বোলিংয়ের ওপর ভর করে ১০০ রানে ম্যাচটি জিতে নেয় ভারত। মনে রাখবেন, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে রবার্টস ছাড়াও গ্রিনিজ, কালিচরন, রিচার্ডস, গিবস আর লয়েডের মতো ক্রিকেটাররা ছিলেন।
ভারতের হয়ে এরপরের স্মরণীয় ৯৭ আসে ১৯৮২ সালে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের প্রায় ছয়-শো রান তাড়া করতে গিয়ে ভারত বেশ বিপাকে। উত্তরে দু’শো রানের কিছু পরেই যখন ভারতের পঞ্চম উইকেট পড়ল তখন ফলো অন প্রায় নিশ্চিত। সেখান থেকেই কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করলেন হরিয়ানা হ্যারিকেন।
উইলিস – বোথাম – প্রিঙ্গল – এডমন্ডসের বোলিংকে বিন্দুমাত্র সমীহ না করে ৯৩ বলে ৯৭ রানের একটা ঝকঝকে ইনিংস খেলে যখন কপিল আউট হলেন তখন ভারত বিপদমুক্ত। নিজের ডাবল সেঞ্চুরির পথে কপিলকে এগিয়ে এসে ছয় মেরেছিলেন বথাম। এবার কপিল বোথামের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল ফেলে দিলেন মিড উইকেট সীমানার পেছনের গ্যালাবিতে। ‘টেনিসের ভাষায় এতক্ষণে থার্টি অল হল!’ – ধারাভাষ্যকারকে বলতে শোনা গেল (সম্ভবত বলেছিলেন স্বয়ং রিচি বেনো)।
এর মধ্যে শচীন টেন্ডুলকার খান দুয়েক ম্যাচ জেতানো ৯৭ করলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে এরপরের বিখ্যাত ৯৭ রানের ইনিংসটি খেলেন গৌতম গম্ভীর। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে মহেলা জয়বর্ধনের কাব্যময় সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ২৭৪ রানের বিশাল স্কোর খাঁড়া করে শ্রীলঙ্কা। উত্তরে খেলতে নেমে শুরুতেই বীরেন্দ্র শেবাগ আর তার কিছু পরেই শচীনকে হারিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে যায় ভারত। এরপর ভারতের ইনিংস মেরামতের কাজ শুরু করেন গম্ভীর ও নবাগত বিরাট।
শেষ পর্যন্ত যখন গম্ভীর আউট হলেন তখন ভারতের জয় নিশ্চিত না হলেও, সম্ভাব্য তো বটেই। ধোনির ছয় মেরে ম্যাচ জেতার দৃশ্য যতটা আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে, গম্ভীরের ৯৭ হয়ত ততটা নেই কিন্তু এই যারা ম্যাচটা দেখেছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন যে ভারতের হয়ে সেই ম্যাচে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস সেটাই ছিল।
এই লিস্টে খুব অল্পের জন্যে স্থান পেল না দুই প্রজন্মের লিটল মাস্টারদের ইনিংস – ব্যাঙ্গালুরুর ধুলোবহুল ঘূর্ণি পিচে সানির ৯৬ আর সেঞ্চুরিয়নে ওয়াসিম আকরাম – শোয়েব আখতার – ওয়াকার ইউনুস – আব্দুর রাজ্জাকের সম্মিলিত আক্রমন ধ্বংস করে শচীনের ৭৫ বলে ৯৮। সম্ভবত ক্রিকেট দেবতা স্কোর রাখতে গণ্ডগোল করে ফেলেছিলেন এই দুই ক্ষেত্রে (নাকি আমাদের স্কোরারদেরই ভুল?)।
আশাকরি কেউ যদি এই অবিস্মরণীয় ইনিংসগুলীর দিকে পান্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাহলে আর না করা তিনটি রানের জন্যে তার ততটা আক্ষেপ হবে না। ঈশ্বর চাইলে ভবিষ্যতে অনেক সেঞ্চুরি করবেন পন্থ, কিন্তু রোজ রোজ তিনি বিশ্বনাথ আর কপিলের মতো ক্রিকেটারদের পাশে নিজের নাম দেখার সুযোগ পাবেন না।
এবারে সবেচেয়ে আশ্চর্যের কথাটা বলি – বিশ্বনাথ তাঁর ৯৭ রানের ইনিংসটি খেলেন ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারির দিন – পান্তের ৯৭ এর ঠিক ৪৬ বছর আগে। না জেনেই ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংসকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে বসে আছেন পান্ত।