ইলেকট্রিশিয়ান জাওয়াদুল্লাহই এখন বাইশ গজের বিদ্যুৎ

দিনভর ইলেক্ট্রিশিয়ানের শক্ত কাজ। সন্ধ্যে নামলেই নিজের প্রথম প্রেম ক্রিকেটের টানে ছুটে যাওয়া। পেশাদারিত্বের বালাই নেই। স্রেফ ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসায় হাজার ক্লান্তি নিয়েও একটানা তিন চার ম্যাচ খেলা। এরপর একদিন হুট করেই ভাগ্য বদল। কঠোর পরিশ্রম, আর নিখাদ প্রেম একদিন বদলে দিল সব।

কাজের সন্ধানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি জমানো ছেলেটা পেয়ে গেল পেশাদার ক্রিকেটের রঙিন পথ। গল্পটা মোহাম্মদ জাওয়াদুল্লাহর। সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতীয় দলের বাঁ-হাতি পেসার তিনি। জন্মস্থান অবশ্য তার পাকিস্তান। পাকিস্তানের খায়বার পাখতুনওয়ার দূর্গম পাহাড়ি জনপদে জন্ম তার।

পাকিস্তানের আর দশটা ছেলের মতই টেনিস বলেই তার ক্রিকেট জীবনের যাত্রার শুরু। তবে পরিবারের হাল ধরতে হবে। জীবনে একটু স্বচ্ছলতা নিয়ে আসা প্রয়োজন। সেই তাগিদেই তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে ছেড়েছিলেন ঘর। তিনিও বোধহয় আন্দাজ করেননি তার জন্য সৃষ্টিকর্তা মরুর দেশে ভাগ্য বদলের গল্প লিখে রেখেছেন।

আমিরাতের আল-আঈন শহরে তিনি কাজ পেয়ে যান। বৈদ্যুতিক কাজে তার দিনের প্রায় নয় ঘন্টা ব্যয় করতেন জাওয়াদুল্লাহ। তবে জীবিকার তাগিদে নিজের পছন্দের বলি তিনি দেননি। ক্রিকেট খেলাও চালিয়ে গেছেন তিনি।অপেশাদার বিভিন্ন লিগে সন্ধার পরই খেলতে নেমে যেতেন জাওয়াদুল্লাহ। দুর্দান্ত বোলিং করতে পারতেন বলে তার কদর বাড়তে থাকে ক্রমশই।

ফিটনেসের কোন বালাই নেই, ডায়েটের কোন হদিস নেই, ভুল শুধরে নেওয়ার কোন প্রশিক্ষণ নেই। স্রেফ খেলার প্রতি টান থেকেই তিনি খেলে গেছেন ক্রিকেট। দিনের একটা বড় সময় কঠিন পরিশ্রম করে কখনো কখনো একটানা তিনটি ম্যাচও খেলেছেন তিনি।

তবে জীবনের তাগিদের করা পরিশ্রম যেন হাওয়া মিলিয়ে গেছে ক্রিকেট ময়দানে। কিন্তু শরীর অবশ্য অতশত বুঝবে কেন! শরীরেরও তো পরিশ্রমের শক্তি জোগানে চাহিদা ছিল। তবে সেটা কখনোই পূরণ হয়নি। কিন্তু পূরণ হয়েছে মোহাম্মদ জাওয়াদুল্লাহর সুপ্ত স্বপ্ন।

এপ্রিলের ২০২২ সালে তার জীবন খুঁজে নেয় নতুন মোড়। যে পথের ভাবনা হয়ত সাহসের অভাবে কখনোই মাথায় আনেননি জাওয়াদুল্লাহ। সেখান থেকেই যে পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার তার যাত্রার শুরু। সেখান থেকেই যে এক নতুন গল্পের শুরু।

২০২২ সালের এপ্রিলে আরব আমিরাত জুড়ে বোলারদের বাছাই করবার এক কার্যক্রম চালানো হয়। সেই কার্যক্রমে মাত্র দুই বল করেই নজর কেড়ে নেন জাওয়াদুল্লাহ। তাকে প্রথমে একটি ইনসুইং বল করতে বলা হয়। সেই বলেই তিনি করে ফেলেন বাজিমাত। কখনো ক্রিকেট বল ছুঁয়ে না দেখা ছেলেটা দারুণ এক ইনসুইং বল করে চমকে দেন উপস্থিত সকলকেই।

ব্যাস! ভাগ্যের চাকা তখন সফলতার পথে অগ্রগামী। সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতীয় দলের ক্যাম্পে সোজা ডাক চলে আসে জাওয়াদউল্লাহর। তবে আইসিসির বিধি-নিষেধের কারণে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও একটি বছর। আইসিসির নিয়মানুসারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হলে, সেই দেশে নিদেনপক্ষে তিন বছর বসবাস করতে হবে।

তবে সেটা অবশ্য জাওয়াদকে আটকে রাখতে পারেনি। বরং তিনি পরিচর্যার এক বলয়ে নিজেকে খুঁজে পান। তার ফিটনেস, ডায়েট ও ক্রিকেট প্রশিক্ষণ তখন হতে থাকে বিশ্বমানের। তবে পেশাদার ক্যারিয়ার তখনও শুরু হয়নি। আরব আমিরাত জাতীয় দলের নেট বোলার হিসেবেই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দলের সাথে।

তবে ২০২৩ সালে এসেই তার পেশাদার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু। তাও আবার আরব আমিরাতের প্রথম ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আইএলটি-টোয়েন্টি দিয়ে। সেখানে তিনি ইয়ন মরগানের অধিনায়কত্বে খেলেছেন। প্রথম উইকেট হিসেবে শিকার করেছিলেন অ্যালেক্স হেলসের উইকেট। তাছাড়া মঈন আলী, মার্কাস স্টোয়িনিসদের মত তারকা ক্রিকেটারদের সাথে একই ড্রেসিংরুমে থাকার অভিজ্ঞতাও হয় তার।

যা তাকে তার এই নতুন জীবনে চলার জ্বালানি জোগায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মরগানের প্রশংসার ভেলায় চড়ে তিনি পৌঁছে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দরজায়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয়। কি রোমাঞ্চকর এক পদযাত্রা!

জীবন সম্ভবত এভাবেই চমকে দেয়। একটুখানি স্বচ্ছলতার খোঁজ করা আজ টি-টেন টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন। কঠোর পরিশ্রম করা জাওয়াদ আজ আলোচনার বিষয়বস্তু। প্রতিভা দিনশেষে খুঁজে নেয় স্পটলাইট। অপেক্ষা শুধুই সঠিক সময়ের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link