একটা বিদেশী গল্প বলে শুরু করা যাক।
পরিবারটার তিন ভাই ক্রিকেট খেলে। এর মধ্যে দুটি ভাই আবার জমজ। এই জমজ ভাইয়েদের মধ্যে যে কি না দু মিনিটের বড়, সে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে গেছে। ছোট জন অপেক্ষায় আছে। এই সময়ের ঘটনা।
একদিন খাবার টেবিলে ‘দু মিনিটের বড়’ ভাই সবাইকে বললো, ‘একটা ভালো খবর আছে, একটা খারাপ; কোনটা শুনতে চাও?’
সবাই ভালো খবরটাই শুনতে চাইলেন। বড় ভাই বললেন, ‘ছোট ভাই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে।’
আর খারাপ?
এবার বড় ভাই হেসে বললেন, ‘ওকে জায়গা দিতে আমি বাদ পড়েছি!’
‘বড়’ ভাইটি স্টিভ ওয়াহ; ‘ছোট’ মার্ক ওয়াহ!
এবার আসেন একটা দেশী, সত্যি গল্প বলি।
আমাদের বাংলাদেশের একটা পরিবারের প্রায় সবাই ক্রিকেট খেলে। বাবা-চাচারা সাত ভাই খেলাধুলা নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। সেই পরিবারের বড় সদস্যের দুটি ছেলে; দুটিই জাতীয় যুব দলে খেলা শেষ করেছে। বড় জন চুটিয়ে তখন জাতীয় দলে খেলছে; টেস্ট সেঞ্চুরি করে দলকে সিরিজ জেতাচ্ছে।
সেই ‘বড় ভাই’ তখন মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখে ফেলেছেন। তখন তিনি দলের বাইরে। এর মধ্যে তার ছোট ভাই হয়ে উঠেছেন দেশের সেরা ওপেনার।
একদিন মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ইনডোরে ঐচ্ছিক অনুশীলনে এসেছি বড় ভাইটি; ডাক পেয়েছেন আবার প্রাথমিক দলে। পরিচিত সাংবাদিকদের দেখে একটু গল্প করছেন। আমরা তখন দুই ভাইয়ের একসাথে জাতীয় দলে ওপেনিং করার দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় আছি। সেরকম সব স্টোরি সাজাচ্ছি।
বড় ভাইয়ের মুখে তখন গর্বের হাসি।
হাসিটা মুখেই ঝুলে রইলো। হঠাৎ একটা বল ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে এলো বড় ভাইয়ের দিকে। ঠিক চোখের ওপরে লাগলো বলটা। শট করা ব্যাটসম্যানটি সেই আপন ছোট ভাই। শিউরে উঠে ছুটে এলো ‘পিচ্চি’ ছোট ভাইটা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো বড় ভাইকে।
চোখের ওপরে আর নিচে দুটো হাড় ভেঙে গেছে।
এখান থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ট্রাজিক ও রোমান্টিক এক গল্প। সেই আঘাতের পর শেষ হয়ে গেলো বড় ভাইয়ের জাতীয় দলে খেলা।
সেই ছোট ভাইটা এখন বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বড় ব্যাটসম্যান। হ্যা, তামিম ইকবাল খান।
আর সেদিন সেই দূর্ঘটনায় ক্যারিয়ারই প্রায় শেষ করে ফেলা সেই বড় ভাইটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আফসোস, নাফিস ইকবাল খান।
আজ আমরা নাফিস ইকবালের গল্প বলতে বসেছি।
মাশরাফির প্রথম অধিনায়ক নাফিস ইকবাল, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিকল্পনা মতো আস্তে আস্তে অধিনায়ক হয়ে উঠতে থাকা নাফিস ইকবাল এবং বাংলাদেশের হাত থেকে ফসকে যাওয়া এক অমিতপ্রতিভাধর ব্যাটসম্যান নাফিস ইকবাল।
নাফিস-তামিমের নিয়তিই ছিলো খেলোয়াড় হওয়া। কারণ, তাদের চাচা আকরাম খান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এক নায়ক। সেটাও একটা বড় কারণ। কিন্তু আসল কারণ হলো নাফিসদের বাবার নাম ইকবাল খান। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া সংগঠক, খেলোয়াড় তুলে আনার কারিগর ইকবাল খান।
ইকবাল খানের ছেলে, আকরাম খানের ভাতিজা হাঁটতে শেখার আগে ব্যাট ধরতে শিখবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই নাফিস যখন ১৫ বছর বয়সে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলে ফেলেন বা অনুর্ধ্ব-১৭ দলের অধিনায়ক হয়ে যান, অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।
নাফিসকে নিয়েই সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রথম দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা শুরু করে। সেই সময় একটার পর একটা বয়সভিত্তিক দলের অধিনায়কত্ব করছিলেন। তার দলও ছিলো তেমন। জহুরুল ইসলাম, জুনায়েদ সিদ্দিকী, মানজারুল ইসলাম রানা, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, মোহাম্মদ শরীফ, তালহা জুবায়ের; কালক্রমে এটি বাংলাদেশের জাতীয় দলে পরিণত হয়েছিলো। দূর্ভাগ্য, সেই দলের অধিনায়ক হয়ে ওঠা হয়নি নাফিস ইকবালের।
প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটাও একেবারে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলো ইংল্যান্ড। ট্রেসকোথিক, ভন, নাসের হোসেন, থর্প, জাইলস, হার্মিস, হগার্ডের সেই দল বিকেএসপিতে একটা অনুশীলন ম্যাচ খেলেছিলো। সেখানে ক্ষুদে এক ব্যাটসম্যান প্রবল দাপুটে এক সেঞ্চুরি করেছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
ম্যাচশেষে ইংলিশ মিডিয়া হামলে পড়লো, ‘আপনি সেঞ্চুরি করে ফেললেন! জাইলসকে তো খুব সহজে খেললেন।’
ছেলেটি হেসে বলেছিলো, ‘জাইলস তো অর্ডিনারি স্পিনার।’
ব্যাস। ইংলিশ মিডিয়া ওই দিন শেষ করে দিয়েছিলো অ্যাশলি জাইলসের ক্যারিয়ার।
আর সেই ব্যাটসম্যাটিই নাফিস ইকবাল। নাফিস অবশ্য স্টিভ ওয়াহ হলেন আরও একবার। কারণ, এটাও আসলে একটা গুজব; নাফিস নাকি কখনোই জাইলসকে ‘অর্ডিনারি’ বলেননি।
স্টিভ যেমন বলেন, হার্শেল গিবসে তিনি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বলেননি যে, ‘বাছা, ক্যাচটাই ফেলে দিয়েছ।’
তবে এই গুজবটা শুনতে স্টিভ ওয়াহর ভালো লাগে। তেমনই নাফিস ইকবাল এতোদিনে আজ বললেন, ‘আমি ঠিক ওভাবে বলিনি। আমাকে ওরা বলছিলো, কোন বোলারকে খেলা কঠিন। আমি বলছিলাম, ওদের পেস বোলিংটা খুব ভালো। সে তুলনায় জাইলস অর্ডিনারি। ওটাকেই ওরা অমন বানিয়ে ফেললো। তা খারাপ কী!’
নাফিস হাসতে থাকেন।
হাসতে হাসতেই ২০০৪ সালে টেস্ট অভিষেক হয়ে গেলো। পরের বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়টা এনে দিলেন ক্ল্যাসিক এক সেঞ্চুরি করে। প্রথম ৬ টেস্টে ১টি সেঞ্চুরি দুটো ফিফটি; সেই সময়ের তুলনায় বেশ ভালো শুরু হলো। অবশ্য ২০০৬ সালটা ভালো যাচ্ছিলো না। শেষ ৫ টেস্টে কোনো ফিফটি ছিলো না। তারপরও আমরা জানতাম যে, নাফিস ইকবাল দ্রুতই রানে ফিরে আসবেন।
সেই সাথে আমরা জানতাম যে, নাফিস ইকবালের মতো ‘অতো ভালো’ না হলেও তার ভাই তামিম ইকবালও আসবে জাতীয় দলে। নাফিস প্রায়শ বলতেন, আমার শেষ স্বপ্ন হলো, দুই ভাই এক সাথে জাতীয় দলে ওপেন করবো।
ইনজুরি থেকে ফিরেছেন। ততোদিনে তামিম অনেক বড় হয়ে গেছেন। নাফিস ফিটনেস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে হালটা ছাড়েননি। প্রবল পরিশ্রম করে ওজন কমিয়েছেন, ফিটনেস ফিরিয়েছেন। কয়েক বছর আগে অবদিও দারুন লড়াই করেছেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে একটার পর একটা বড় স্কোর করে চেষ্টা করছিলেন স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য। কিন্তু কোথাও কোনো ইশারাও মিলছিলো না।
আর পারলেন না।
২০১৩ বিপিএল অবদিও চেষ্টা করেছেন। পরের বছর বিপিএল শুরুর আগেই বলে দিয়েছেন, টি-টোয়েন্টি আর নয়। তাই খুলনা টাইটান্সের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি কয়েক বছর ধরেই পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কয়েকটা ব্যবসা শুরু করেছেন। লালখান বাজার ও জামাল খানে ‘দাম ফুক’ নামে দুটো রেস্তোরা করেছেন। ব্যবসাটা অবশ্য অন্য অংশীদাররাই দেখছেন।
২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটও খেলেছেন। শেষ পর্যন্ত কোথাও আলো না দেখে ক্রিকেট ছেড়ে অল্প বয়সেই ম্যানেজমেন্টে ঢুকে গেছেন। ছোটবেলা থেকেই তুখোড় অধিনায়ক নাফিস এই পেশাতেই ভালো করার স্বপ্ন দেখেন, ‘আমার প্যাশনটা হলো ম্যানেজমেন্ট। আমি সবসময় মনে করি, মন থেকে যে পেশাটা ভালো লাগে, সেটা করা উচিত। আমি আমার খেলোয়াড়ি জীবন থেকে মানুষ নিয়ে কাজ করা, ব্যবস্থাপনা— এসব কাজ করতে পছন্দ করি। তাই যখন সুযোগ এলো, আমি এই পেশাটাকে বেছে নিয়েছি। আমি আমার জীবনে যত ক্রিকেট খেলেছি, তার অধিকাংশ সময়ই অধিনায়ক ছিলাম। আমি যখনই কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত হতাম, ঐ দলের জার্সি ডিজাইন থেকে শুরু করে সবকিছুতে জড়িত থাকতাম। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের স্বচ্ছন্দের জন্য আর কী করা যায়, সেটা ভাবতাম। ওখান থেকেই হয়তো এই ব্যাপারটা এসেছে।’
এখন জাতীয় দলের ম্যানেজার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আরও হয়তো অনেক এরকম ব্যবস্থাপনার কাজ করবেন। কিন্তু খেলোয়াড় নাফিসকে নিয়ে আমাদের আফসোস তো শেষ হওয়ার নয়। নাফিস অবশ্য বলেন, নিজের কাছে সত থাকার জন্যই আগে আগে খেলাটা ছেড়ে দিয়েছেন, ‘আমি যখন খেলা ছাড়ি, আমার বয়স ছিলো ৩২। হ্যাঁ, খেলা হয়তো আমি আরো দু-চার বছর জোর করে চালাতে পারতাম। কিন্তু আমি নিজের কাছে অনেস্ট থাকতে চেয়েছি। আমি যে মৌসুমে খেলা ছেড়েছি, তার আগের বছরও ক্যাপ্টেন ছিলাম। কখনো কখনো আমি দেখলাম, ফিল্ডার হিসেবে মাঠে আমাকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছিলো। মানে, আমি সেরা অবস্থায় ছিলাম না। ক্রিকেট আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি খেলাটার সঙ্গে প্রতারণা করতে চাইনি। মনে হয়েছে, আমার সময় শেষ।’
তাই হোক, নাফিস খেলোয়াড় না হলেও ক্রিকেটেই থাকুন। শুভকামনা।