ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটা বাংলাদেশে আসার পর থেকে এখানে রাকিম কর্নওয়ালকে নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে তাকে নিয়ে হইচই চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। দুনিয়ার নামকরা সব সংবাদ মাধ্যম তাকে নিয়ে ফিচার করছে, ভিডিও বানাচ্ছে এবং আকর্ষনীয় সব হেডিং দিচ্ছে। আর এর মধ্যেই একটা গুরুতর প্রশ্ন উঠে পড়েছে, দুনিয়ার সবচেয়ে ওজনদার এই খেলোয়াড়কে নিয়ে এতো হইচই করে কী তাকে ‘বডিশেমিং’ করা হচ্ছে?
প্রশ্নটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
খেলাধুলা কেনো, জীবনের কোনো পর্যায়েই বডি শেমিং বা রেসিস্ট কোনো মন্তব্য করা ঘোরতর অপরাধ। এমনকি এসব ইঙ্গিত বহন করে, এমন কথাও বলাটা অন্যায়। এখন আমাদের বিবেচ্য হলো, আসলে কী এসব হেডিং করায় রাকিমের বডিশেমিং করা হচ্ছে?
এখানে সুক্ষ একটা লাইন আছে। আমরা সেই লাইনের ওপর দিয়ে হাটছি। এই লাইনটা কেউ অতিক্রম করলেই সেটা শরীরি অপমান বা বডিশেমিং হবে। আবার অতিরিক্ত পিছিয়ে এলে আপনি বাস্তবতা থেকে অনেক পিছিয়ে গেলেন।
একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক।
শচীন টেন্ডুলকার বা হানিফ মোহাম্মদ বা স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে আমরা লিটল মাস্টার বলি। এটা বডি শেমিং নয়। আমরা আদর করে, ভালোবেসে তাদের এটা বলছি। আবার আমাদের মুমিনুল হককেই আমরা ‘পকেট ডায়নামো’ বলছি। এমনকি মুশফিকুর রহিমকেও ‘পকেট রকেট’ লেখা হয়েছে একসময়। এগুলোর সবই আদরের ডাক; একটা উপাধি দেওয়া। এতে অপমান হয় না।
কিন্তু আপনি যদি এই আদরের কম উচ্চতার খেলোয়াড়দের কাউকে ‘বেটে’ বলে ডাকেন, সেটা কী ভালো হবে? হবে না। এটাই আসলে পার্থক্যটা। আপনাকেই বুঝতে হবে যে, কোনটা শোভন, কোনটা অশোভন।
রাকিমের বেলাতেও তাই হয়েছে।
তার উচ্চতা সাড়ে ৬ ফিট। ওজন ১৪০ কেজি। তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ওজনদার খেলোয়াড়। ফলে তার আকৃতি নিয়ে হৈ চৈ হবেই। এই হৈ চৈ কখনোই বডি শেমিং নয়।
সবচেয়ে বেশী রান করা খেলোয়াড়কে নিয়ে হইচই হয়, সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়া খেলোয়াড়কে নিয়ে হইচই হয়। তেমনই সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে কম উচ্চতার ক্রিকেটারকে নিয়েও হইচই হয়। ৭ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার মোহাম্মদ ইরফানকে নিয়ে কেমন হইচই হয়েছিলো, মনে আছে?
মুশফিকুর রহিম ও ইরফান একসাথে ছবি দিয়েছিলেন। তাতে মুশফিক বা ইরফান কারোরই ‘বডি শেমিং’ হয়নি। ওটা ছিলো মজা। মানুষ এই মজার জন্যই বেঁচে আছে।খেলা মানে কেবল মুখ গোমড়া করে পরিসংখ্যান আওড়ানো নয়। এখানে ওজন নিয়ে, উচ্চতা নিয়ে কথা হবে; তবে সেই কথাটা কিছুতেই যেনো সীমা অতিক্রম করে বুলিংয়ের দিকে না যায়।
ফলে রাকিবকে নিয়ে করা নিউজে তার ওজনের প্রসঙ্গ আসবে। রাকিমকে নিয়ে আড্ডায় তার আকৃতি নিয়ে কথা হবে। এগুলোতে নিজেদের অপরাধী ভাবার কোনো মানে নেই। বা কেউ এরকম বললেই তার প্রতি ‘রে রে’ করে ওঠার কিছু নেই।
বাংলাদেশের মিডিয়াই এটা করছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডের মত খাটি ব্রিটিশ পত্রিকা হেডিং করেছিলো, ‘হু ইস রাকিম কর্নওয়াল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি ও ২২ স্টোন স্পিনার।’ এ ছাড়া আমি এক পলকে দেখতে পাচ্ছি, রাকিমের এই উচ্চতা-ওজন নিয়ে টেলিগ্রাফ, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড স্ট্যাফ, এনডিটিভির মতো সংবাদ মাধ্যম স্টোরি করেছে। এরা সবাই বডি শেমিং, রেসিজম ব্যাপারগুলোর ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা বার্তা সংস্থা।
ফলে আমাদের দেশে ‘ওজনদার রাকিম’ টাইপের নিউজ হবেই। এটা নিয়ে হা হুতাশ করা বা অতি সচেত হয়ে গালিগালাজ করার কোনো কারণ নেই। বরং এই অতিসচেতনতা নতুন করে এই বিষয়টাকে জটিল করছে।
হ্যাঁ, আমরা রাকিবকে শ্রদ্ধা দেখাতে ভুল করবো না। তার মূল যে ব্যাপারটা, সেই ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা যেনো এই শরীর বিষয়ের আলোচনায় ভেসে না যায়। এখানে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। সেই সাথে সতর্ক থাকতে হবে রাকিমকে অসম্মান করা হয়, এমন কিছু যেনো আমরা লিখে না ফেলি।
ইংলিশরা যতই কথায় কথায় ‘জায়ান্ট’ লিখুক, তার অনুবাদ ‘দানব’ করলে, সেটা অবশ্যই অবমাননাকর। ফলে শব্দের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
একটু সতর্কতা, সচেতনতা ও ভদ্রতা ভেতরে থাকলে তারপর আপনি মজা করলেও সেটা শোভনই হওয়ার কথা।
রাকিমের জয় হোক; অবশ্যই বাংলাদেশের বিপক্ষে নয়।