মেসি: বোঝা, নাকি সোনার হরিণ?

সাদা চোখে যদি মনে হয় যে মেসির বেতন মেটাতে গিয়ে বার্সার এই দশা, তবে আপনি অবশ্যই ভুল করছেন। মেসির এতো বেতন যেমন বার্সার ওয়েজ স্ট্রাকচারে বিশাল প্রভাব ফেলছে, তেমনই মেসি বার্সেলোনার অর্থনীতিতে বড় প্রভাব রেখে চলেছে এতোদিন ধরে।

মেসির সাথে ২০১৭ সালে হওয়ার বার্সেলোনার বিশাল চুক্তির নথিপত্র ফাঁস করে দিয়েছে স্প্যানিশ পত্রিকা মুন্ডো দেপোর্তিভো। তাদের মতে গত ৪ বছরে মেসির পেছনেই বার্সার খরচ হয়েছে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ইউরো। কিন্তু আসল ঘটনার পেছনেও ধূমায়িত কিছু সত্য লুকায়িত থাকে, সেটিই বের করার চেষ্টা করি আমরা।

লিওনেল মেসি বার্সেলোনা ছাড়ছেন, মিডিয়ার কাছে এর থেকে বড় খবর আর কিছুই হতে পারে না। বলতে গেলে নেইও। জুন মাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে বার্সেলোনার সাথে চলমান চুক্তি। অতএব এরপর মেসি যোগ দিতে পারেন যেকোনো ক্লাবে। এমনকি চুক্তি অনুযায়ী শেষ ছয়মাসে যেকোনো ফ্রি এজেন্ট অন্য ক্লাবের সাথে নিজেই মৌখিক ও আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে পারেন পরবর্তী মৌসুমের জন্য। এখনও যখন বার্সা আলোচনায় বসেনি নতুন চুক্তি নিয়ে তাহলে ধরেই নেওয়া যাচ্ছে, এই মৌসুমেই যবনিকাপাত ঘটছে মেসি আর বার্সার এতোবছরের জার্নির।

তবে এর মধ্যেই মিডিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বার্সেলোনাভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ‘এল মুন্ডো দেপোর্তিভো’। তারা এক গোপন নথি প্রকাশ করেছে যাতে পাওয়া গিয়েছে লিওনেল মেসির সাথে বার্সার চুক্তিপত্রের সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ। বলাবাহুল্য খেলোয়াড়দের এমন চুক্তিপত্র খুব সহজে বাইরে আসে না, তাই বড় বড় খেলোয়াড়দের চুক্তি-বেতন-বোনাস সবটাই মিডিয়ার আন্দাজে বলা। তাঁর সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব নয় বললেই চলে। কিন্তু মেসির চুক্তির খবর হুট করে বাইরে চলে আসা, যেন পুরো ফুটবল বিশ্বের জন্যই ধাক্কা।

তাঁর থেকে বড় বিষয় হচ্ছে টাকার অংকটা। ২০১৭ সালে করা চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ পর্যন্ত বার্সেলোনায় থাকলে মেসি একাই আয় করবেন মোট ৫৫৫ মিলিয়ন ইউরো। বাংলা টাকায় যা প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা!

লিওনেল মেসির সাথে বার্সেলোনা তাদের শেষ চুক্তি করে ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালের জুনে বার্সার সাথে চুক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার সময় আসায়, এক বছর আগেই মেসির সাথে চুক্তি করে আরো ৪ বছর বার্সেলোনায় থাকার ব্যবস্থা করে নেয় কাতালান ক্লাবটি। মুন্ডো দেপোর্তিভোর মতে বেতন ও বোনাস মিলিয়ে প্রতিবছর মেসিকে বার্সেলোনার দিতে হচ্ছে ১৩৮ মিলিয়ন ইউরো। সেটা শুধু প্রতিবছর, ৪ বছরে তা দাঁড়ায় ৫৫৫ মিলিয়নে। আরো কাঁটাছেড়া করলে ভালোমতো বোঝা যাবে জিনিসটা।

চুক্তির সময় সাইনিং বোনাস হিসেবে বার্সেলোনা মেসিকে দিয়েছিল মোট ১১৫ মিলিয়ন ইউরো। সেটা শুধু সেই কাগজে সাইন করেই পেয়েছেন মেসি। সেই সাথে চুক্তিতে ছিল, মেসি যদি তাঁর চুক্তির শেষদিন পর্যন্ত বার্সেলোনায় থাকেন, তবে তিনি পাবেন আরো ৭৮ মিলিয়ন ইউরো। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘লয়্যালিটি ফী’। এ তো গেল শুধু এককালীন দেনা-পাওনার হিসাব। আর প্রতিবছর খেলোয়াড় হিসেবে বেতন, ট্রফি-গোল করলে বোনাস তো আছেই। সেই সবকিছু মিলিয়ে শুধু মেসির পেছনেই বছরে বার্সার খরচ প্রায় ১৩৮ মিলিয়ন ইউরো।

বলা বাহুল্য, এই খবরটা এমন একটা সময় লিক হয়েছে যখন বার্সেলোনার শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। এমনিতেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বিদায় নিয়েছেন চারপাশের সমালোচনায়, কোচ কোম্যানও দল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন এবং দলের উপর ১.২ বিলিয়ন ইউরোর দেনা। এমন অবস্থায় মেসির পুরো ফাইনানসিয়াল স্টেইটমেন্ট ফাঁস হওয়ায় বেশ বিপাকেই পরেছে দুইপক্ষ। এর থেকে বড় হলো মেসি বা বার্সেলোনা কেউই এই নথিপত্রকে অস্বীকার করেনি। উল্টো তারা মামলা দিয়েছে মুন্ডো দেপোর্তিভো পত্রিকার বিরুদ্ধে তাদের ক্লাবের গোপন নথিপত্র ফাঁস করে দেওয়ায়। বলাই যায়, এখানে বেশ ভালোপরিমান সত্যতা রয়েছে বৈকি।

সাদা চোখে যদি মনে হয় যে মেসির বেতন মেটাতে গিয়ে বার্সার এই দশা, তবে আপনি অবশ্যই ভুল করছেন। মেসির এতো বেতন যেমন বার্সার ওয়েজ স্ট্রাকচারে বিশাল প্রভাব ফেলছে, তেমনই মেসি বার্সেলোনার অর্থনীতিতে বড় প্রভাব রেখে চলেছে এতোদিন ধরে।

মুন্ডোর ফাঁস করা নথি থেকে আপনার মনেই হতে পারে, মেসিই বার্সেলোনার ভিলেন। ক্লাবের এমন অবস্থায় নিজের বেতন না কমিয়ে দিনশেষে দলের অবস্থাই খারাপ করছেন। কিন্তু পুরো গল্পটা এমন না অবশ্য। মেসি যে বার্সেলোনার অর্থনীতির বড় একটা অংশ, সেটা ভুলে যাবেন না যেন। মেসির প্রতি বছর ১৩৮ মিলিয়ন ইউরোর অনেকটা ‘নেসেসারি ইভিল’। এতো বড় অংক দিয়ে তাকে রাখা নিজেদের লাভের জন্যই।

মেসি বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ শার্টসেলার। গতবছর এই প্যান্ডেমিকের মধ্যেও মোট ২ মিলিয়ন অফিসিয়াল জার্সি বিক্রি হয়েছে শুধুমাত্র লিওনেল মেসির। যার দাম ১০০ থেকে ২০০ ইউরো। প্রতিটি অফিসিয়াল জার্সি সেলের ১৫% পায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সে হিসেবে বার্সা প্রায় ৩৭ থেকে ৫০ মিলিয়ন আয় করেছে শুধু তাঁর জার্সি সেল করেই। এছাড়াও মেসির ব্র্যান্ড ভ্যালুর কথা ভুললে চলবে না, এক মেসির নামে যেখানে সারা পৃথিবী কাঁপে, সেখানে মেসির জন্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিশাল স্পন্সর পায় বার্সা। মেসি ছাড়াও যে পেত না, বিষয়টা তা নয়। তবে মেসি আছে বলেই টাকার অংকটা অনেক বেশি।

‘কোনামি’র ভিডিও গেম ‘প্রো ইভ্যুলুশন সকার’ ‘পেস’-এর মূল দল এই বার্সাই। বলা বাহুল্য মেসিকে কাভার করতে গিয়েই পুরো বার্সা ও ক্যাম্প ন্যুকে নিজেদের চুক্তিতে শামিল করেছে তারা। প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের টাকাও আসছে এই সোর্স থেকে। মিডিয়া রাইটস, ফটো রাইটস কিংবা টিকিট বিক্রিতে মেসির প্রভাব না হয় বাদই দিলাম।

২০১৯ সালের দিকে বার্তেমেউ মেসির সাথে আরেকটু চুক্তি সাক্ষর করতে বসতে চেয়েছিলেন, তাতে করে মেসির সাথে আজীবন চুক্তি থাকবে বার্সার। তার সুবিধা অনুযায়ী মেসির আজীবন ব্র্যান্ড ও ফটো রাইটসের অধিকার থাকবে বার্সার হাতে। যদিও মেসি রাজি হননি। নইলে সেখান থেকেও প্রতি বছর বিশাল অংকের টাকা আয় করতে পারতো বার্সেলোনা। প্রতি বছর কম করে হলেও শুধুমাত্র মেসির নামের উপর ভর করেই প্রায় ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো আয় করে বার্সা। সেটা শুধু মেসির কাছ থেকেই। মেসির সাথে অন্যান্য খেলোয়াড়দের পার্টনারশিপ করে করা অ্যাড কিংবা স্পন্সর থেকে নয়।

বার্সেলোনার আজকের এমন দশার পেছনে শুধু মেসির এতো বেতন নেওয়াই দায়ী না। বরং তাদের বাজে পলিসি এবং ওয়েজ বিল কন্ট্রোল না করতে পারাই আজ তাদের এমন অবস্থার সম্মুখীন করেছে। মুন্ডো যেখানে মূদ্রার একপিঠ দেখিয়ে মেসিকেই পুরো ঘটনার ভিলেন বানাচ্ছে, ঘটনা ঠিক তেমনটাও নয়। এক কথায় বলতে গেলে মেসি বার্সার কাছ থেকে যতটা পয়সা নেয়, তাঁর থেকে বেশি উসুল করে দেয় তাঁর পারফরম্যান্স আর স্পন্সর দিয়ে। মেসি আর বার্সেলোনা দুজন দুজনের পরিপূরক, অন্তত বর্তমান অবস্থান আরকী। আগামী ৫ মাস পর কী হবে, তা এখনই বলা কঠিন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...