আজহার মেহমুদ, অনালোচ্য তবে কার্যকর

নব্বই দশক। পাকিস্তান ক্রিকেটের সাফল্যযাত্রায় এই সময়কালকেই সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিবেচনায় করা হয়। কেননা এই এক দশকেই তাঁরা দু’বার বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছিল। তাছাড়া সে সময় পাকিস্তান দল ছিল যথারীতি তারকায় ঠাসা। ওয়াসিম-ওয়াকার-শোয়েব পেসত্রয়ীর আগুনে কাঁপত অন্য দলগুলো। সাকলাইন মুশতাকের স্পিনজাদু তো ছিলই। ঠিক সেই দশকেরই শেষাংশে আলোর রোশনাই ছড়িয়ে দিতে পাকিস্তান ক্রিকেটে পা পড়েছিল আজহার মেহমুদের।

অনুল্লেখ্য, তবে কার্যকর। আজহার মেহমুদের বেলায় এই মন্তব্যটা একদম যথাযথ। তবে এর বিপরীতে আক্ষেপও রয়েছে ঢের। ক্যারিয়ারে দুর্দান্ত শুরুর পরও কেন সেভাবে নিজেকে শীর্ষদের কাতারে আনতে পারেননি, সেই প্রশ্নসূচক আক্ষেপ এখনও রয়েছে তাঁকে নিয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে দারুণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও ক্রিকেটের কূলীন ফরম্যাটে নিজেকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিতই করতে পারেননি নিজেকে। উল্টো এই শতাব্দীর ক্রিকেট অনুরাগীরা তাঁকে মনে রেখেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা হিসেবে।

মিডল অর্ডারে কার্যকরী ব্যাটিং, সাথে পেস বোলিং। পাকিস্তান ক্রিকেটে নিজেকে খাটি পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই পরিচিতি করিয়েছিলেন আজহার মেহমুদ। তবে ক্যারিয়ারে কখনোই ধারাবাহিকতার সাগরে ভাসাতে পারেননি। বরং বার বার ডুবেছেন, ডুব দিয়ে ফিরেছেন। আর এই ফেরার লড়াইয়ে লড়াকু যোদ্ধা হিসেবেই গোটা ক্যারিয়ার পার করেছেন। ক্যারিয়ারে সমৃদ্ধি আসেনি। তাই পাক কিংদন্তিদের সারিতেও তাঁর নামটা বসে না সেই ভাবে।

তবে সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে বর্ণিল এক ক্যারিয়ার আজহার মেহমুদের। স্বীকৃত ক্রিকেটে ১৩৭৯ উইকেটের পাশাপাশি ১৮৭৭০ রান সেটিরই মাহাত্ম্য বহন করে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই দারুণ সক্ষমতা নিয়েই হাজির হয়েছিলেন এ ক্রিকেটার। ১৯৯৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেই হাঁকিয়েছিলেন দারুণ এক সেঞ্চুরি। সেখানেই শেষ নয়, পরের ইনিংসেই পেয়েছিলেন ফিফটি।

এরপর সেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই পরের বছর টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম ৮ টেস্ট শেষে আজহার মেহমুদ তখন ৭৭ গড়ের টেস্ট ব্যাটার। কিন্তু এরপর যত সময় গড়িয়েছে, বার বার ব্যর্থতার গ্লানি মেখেছেন এ ক্রিকেটার। টেস্ট ক্যারিয়ারের ৩ সেঞ্চুরির সাথে ১ ফিফটি পেয়ে যান সেই ৮ টেস্টেই। এরপর গুণে গুণে ১৩ টা টেস্ট খেলেছেন। কিন্তু একবারের জন্যও পেরোতে পারেননি পঞ্চাশের গণ্ডি। ফলত, নব্বই গড়ের আজহার মাহমুদের টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে মাত্র ৩০ গড়ে।

অবশ্য টেস্ট ক্রিকেটের স্থায়ীত্বকাল ৪ বছর হলেও ওয়ানডেতে পাকিস্তানের হয়ে তিনি কাটিয়েছেন ১১ টা বছর। ১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু করে। এরপর ১৪৩ টা ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তাতে ১৫২১ রানের পাশাপাশি বল হাতে ১২৩ টি উইকেট নিয়েছেন। পাকিস্তানের হয়ে দুটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। এর মধ্যে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ১৩ উইকেট ও ব্যাট হাতে ১১৭ রান নিয়ে দলকে ফাইনালে তোলার পিছনে কার্যকরী অবদান রেখেছিলেন। এরপর ২০০৩ বিশ্বকাপে সুযোগ না হলেও খেলেছিলেন ২০০৭ বিশ্বকাপে। যে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে পাকিস্তান।

মূলত ২০০১ সালের পরই ফর্ম হারিয়ে ফেলেন আজহার। পাকিস্তান ক্রিকেটে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ২০০২ সালে তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। চুক্তিবদ্ধ হন কাউন্টি দল সারের সাথে। এরপর সেখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করেন তিনি। সেই যাত্রায় ২০০৫ সালে পূর্ণ ব্রিটিশ নাগরিকত্বও পেয়ে যান আজহার। এরপর ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে রীতিমত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা বনে যান তিনি।

আইপিএল, বিগ ব্যাশ, সিপিএল কিংবা বিপিএল, সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেই বিচরণ ছিল তাঁর। এমনকি আইপিএলে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের নিষেধাজ্ঞার সময়েও ব্রিটিশ পাসপোর্টে তৎকালীন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে খেলেছিলেন তিনি। অবশ্য ২০১৬ সালে পেশাদার ক্রিকেটারকে বিদায় জানিয়ে দেন তিনি। এরপর কোচিং পেশাতেই যুক্ত হন এ ক্রিকেটার। এখন পর্যন্ত বেশ কিছু দলসহ পাকিস্তানের বোলিং কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

যতটা সম্ভাবনা নিয়ে আজহার মেহমুদের ক্রিকেটে পা পড়েছিলেন, তার সবটা হয়তো মেলে দিতে পারেননি তিনি। পাকিস্তান ক্রিকেটে তাঁর নাম হয়তো আক্ষেপের সাথেই উচ্চারিত হয়। তবে ক্যারিয়ার বিবেচনায় বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ই পার করেছেন তিনি। দারুণ, অনবদ্য কিছু না নিশ্চয়ই, তবে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে আজহার মেহমুদ নামটা দারুণ ইম্প্যাক্টফুল।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link