জোমেল ওয়ারিক্যানকে প্যাডেল সুইপ করলেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
দ্বিতীয় রান নিতে নিতেই হেলমেট খুলে ফেললেন। ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের দিকে তাকিয়ে উদযাপন করলেন। অভ্যাসবশতই গ্যালারির দিকে ফিরেছিলেন। একটু হতাশ হলেন যেনো। তারপর টিভি স্ক্রিনের নিচে তাকাতেই হতাশা কেটে গেলো।
সাগরিকা স্টেডিয়ামের বিরাট সাগরের মতো বিরান স্টেডিয়ামে একজন অন্তত মানুষ আছেন এই মিরাজদের সাহস জোগাতে। সেঞ্চুরির পর একটা কণ্ঠ অন্তত চিৎকার করে উঠলো-সাবাশ, মিরাজ; সাবাশ।
হ্যা, লোকশূন্য এই বিশাল স্টেডিয়ামে এই একমাত্র ‘দর্শক কণ্ঠ’ আমাদের শোয়েব আলী; টাইগার শোয়েব।
বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই টাইগার শোয়েবের সরব উপস্থিতি। যারা বাংলাদেশের খেলা টেলিভিশনে বা মাঠে গিয়ে সরাসরি দেখেন, তারা জানেন, মাঠে খেলোয়াড়ের বদল হতে পারে, দলের বদল হতে পারে, পরিস্থিতি বদলাতে পারে; দর্শক সারিতে একজনের কোনো পরিবর্তন নেই। তাকে ছাড়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচ কল্পনাই করা যায় না। পাকিস্তান বা ভারতের যেমন ‘আইকন’ সমর্থক আছেন—জলিল চাচা বা সুধীর; বাংলাদেশের আইকন সমর্থক এখন শোয়েব আলী।
বাংলাদেশের প্রতিটা খেলার সময়, অনুশীলনের সময় বাঘের মতো সারা শরীর অলঙ্কৃত করে অবিরাম চিৎকার করে চলেন শোয়েব আলী বুখারী।
কিন্তু সেই গর্জনটাও থামিয়ে দিতে চেয়েছিলো করোনা।
করোনা সারাবিশ্বেই খেলার মাঠে যেতে চাওয়া দর্শকদের থামিয়ে দিয়েছে। ফলে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামেই আজকাল চলছে খেলাধুলা। আর এ কারণেই ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতোই টাইগারের গ্যালারিতে থাকা নিয়ে সংশয় তৈরী হয়েছিলো। কিন্তু নিয়তি তো ভালোবাসার পক্ষেই থাকে। তাই সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান ‘টি স্পোর্টস’ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে জায়গা হয়েছে তার। ফলে সাগরিকা আর জনহীন প্রান্তর হয়ে থাকেনি। ভিআইপিবক্স, প্রেসবক্স আর ড্রেসিংরুমের বাইরেও একটা কণ্ঠ চলেছে এখানে।
ফরিদপুরের ছেলে শোয়েব পেশায় ছিলেন একজন মোটর মেকানিক। মেকানিকের কাজ করতে করতে খেলার প্রেমে ঠিকই পড়ে গিয়েছিলেন। শোয়েব যতদূর মনে করতে পারেন, বাংলাদেশের খেলা নিয়ে তার নেশাটা পাগলামিতে পরিণত হয় ২০০৩ সালে বাংলাদেশের পাকিস্তান সফরের সময়।
এর আগেও খেলাটা নিয়ে তার উন্মাদনা ছিল। কিন্তু সেবার বিশেষত মুলতান টেস্টে দলের খেলা দেখে, বলা যায় পরাজয়টা দেখে তিনি প্রেমে পড়ে যান বাংলাদেশ দলের। তার মনে হচ্ছিল, মুলতানে যদি গ্যালারিতে বাংলাদেশের হয়ে কেউ চিৎকার করতে পারতো, তাহলে ১ উইকেটের ওই ট্রাজিক হারটা সহ্য করতে হত না।
শোয়েব প্রথম মাঠে গিয়ে খেলা দেখেন ২০০৪ সালে; নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশ সফরের সময়। আফতাব আহমেদ ৫ উইকেট নিলেন, কিন্তু ম্যাচ হেরে গেল বাংলাদেশ। সে সময়ও তার মনে হয়েছে, গ্যালারিতে বসে এমন কিছু করা দরকার, যাতে খারাপ সময়েও খেলোয়াড়রা উৎসাহ পান।
একটা উপায় আছে চিত্কার করা; সেটা সবাই করেন। শোয়েবই বলছিলেন পরের উপায়টা মাথায় আসার কথা, ‘আমার মনে হল, একটা কিছু করা দরকার, যাদের খেলোয়াড়রা দূর থেকে দেখে শক্তিটা পায়। ভাবলাম যে, শরীরে জাতীয় পতাকার রং করবো। আর মুখটা বাঘের মতো করে আঁকবো। তাহলে আমার চিৎকার শুনে খেলোয়াড়রা উৎসাহ পাবে।’
এই ভাবনা কাজে লাগাতে অবশ্য সময় লাগলো। ২০১১ সালের এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো এমন সাজে গ্যালারিতে হাজির হয়েছিলেন শোয়েব। সে অভিযানেই সফল। সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে, দুই বিশ্বকাপ জয়ী দলকে ছিটকে দিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ!
অবশ্য কাজটা সহজ ছিল না শোয়েবের জন্য।
প্রথমে চারুকলায় গিয়ে এক শিল্পীকে খুঁজে বের করলেন। তিনি শোয়েবের চাহিদা মতো শরীরে রং করে দিলেন। প্রতিবার রং করতে ১৫০০ টাকা। শোয়েব হেসে বলেন, ‘পকেটে নাই টিকিট কেনার টাকা! এতো টাকা কি করে রোজ দেব। তাই রং কিনে আয়নার সামনে বসে নিজেই এরপর থেকে একে ফেলা শুরু করলাম।’
সেই শুরু। এরপর থেকে বাংলাদেশের খেলা মানেই মাঠে শোয়েব আছেন, টাইগার আছে। বাংলাদেশের খেলা দেখতে জীবন হাতে নিয়ে, প্রায় সর্বস্ব বিক্রি করে শ্রীলঙ্কা গেছেন। সেখানে গ্যারেজে থেকেছেন, খেলোয়াড়দের দেয়া টাকায় খাওয়া চলেছে। জিম্বাবুয়ে গেছেন খেলোয়াড়দের দেয়া টাকায়। বাঘ সাজার আগেই ২০০৬ সালে ডিসকভারির মতো করেই ভারতে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলা দেখবেন বলে।
শোয়েবের উত্সাহ, শোয়েবের পাগলামি নিয়ে বলতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে।
শরীরে একশ’ পাঁচ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে খেলা দেখেছেন, প্রবল শীতের দিনে খুলনায় খালি গায়ে খেলা দেখতে গিয়ে নিউমোনিয়া বাধাতে বসেছিলেন, সস্তা রং দিয়ে শরীর রাঙাতে গিয়ে চর্মরোগ বাধিয়ে বসেছিলেন। যে খালুর কাছে মানুষ হয়েছেন, সেই খালুর মৃত্যু খবর পেয়েও খেলা ছেড়ে যাননি।
২০১১ সাল থেকে দেশের মাটিতে কোনো খেলা মিস করেননি। দেশের বাইরেও এর মধ্যে অন্তত ৬টি দেশে গিয়েছেন দলের পাশে থাকার জন্য। আজকাল খরচটা সমস্যা হয় না। কেউ না কেউ, কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান পাশে থাকে।
সেভাবেই এবার গ্যালারিতে ঢোকার পর অবশ্য এই অসীম শূন্যতা খুব মন খারাপ করে দিয়েছে শোয়েবের। অনেক অভিজ্ঞতা তার জীবনে হয়েছে, কিন্তু এমন শূন্যতা আগে কখনো দেখেননি। ম্লান হেসে বলছিলেন, ‘শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়েতে একা বাংলাদেশী সাপোর্টার হিসেবে মাঠে ছিলাম। তাও এমন শূন্য গ্যালারি ছিলো না। আর দেশের মাটিতে তো এরকম কল্পনাই করা যায় না। এই সাগরিকায় খেলা হলে কতো লোক হয়! মানুষ ঢোল-বাজনা নিয়ে মাঠে আসে। আমি ‘জিতবে কে’ বলে চিৎকার করলেই সবাই ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে। কিন্তু এবার সেই উত্তর দেওয়ার লোকটাও নেই।’
তারপরও শোয়েবের এই উপস্থিতি লোকেদের নজর কেড়েছে। পাকিস্তান থেকে জলিল চাচা এবং ভারত থেকে সুধীর ফোন করেছিলেন। দু জনই যার যার দেশে টেস্ট দেখতে পারছেন না। শোয়েব বলছিলেন, ‘চাচা আর সুধীর ভাই ফোন করেছিলো। ওরা বললো, তুমি লাকি যে এই সময়ে মাঠে যেতে পারছ। সুধীর অনেক কষ্ট করে বিহার থেকে কলকাতায় এসেছিলো দাদার (সৌরভ গাঙ্গুলি) সাথে দেখা করে খেলা দেখার পারমিশন নেবে বলে। কিন্তু দাদা আবার হার্ট অ্যাটাক করলো এই সময়ে। ফলে ওরা দু জনই খেলা দেখতে পারছে না। আমার আসলেই কপাল ভালো যে, খেলা দেখতে পারছি।’
শোয়েব মনে করেন, খেলোয়াড়রাও এই নিষ্প্রান গ্যালারির সামনে খেলে উৎসাহ পান না। তারাও একটু অধীর হয়ে খোজ করেন গ্যালারির উল্লাস। কিন্তু কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে শোয়েব খুবই সম্মান দেখান, ‘আসলে বোর্ডের তো উপায় নাই। এটা তো একটা মহামারী চলছে। ফলে ঝুকি তো বোর্ড নিতে পারবে না।’
এখন শোয়েব স্বপ্ন দেখেন, দ্রুত আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার দল বেঁধে মানুষ আসবে গ্যালারিতে, মেতে উঠবে ক্রিকেট উৎসব। সেই জীবন আবার শুরু না হওয়া পর্যন্ত শোয়েবই ভরসা।
চলতে থাকুক টাইগারের গর্জন।