দিশাহীন জাহাজের পাইলট

সময়টা ২০০৬ সালের শেষ দিকের কোনো একটা মাস সম্ভবত।

মুশফিকুর রহিম তখন জাতীয় দলে; তবে স্রেফ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন। কিপিং করছেন তখনও বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা কিপারদের একজন খালেদ মাসুদ পাইলট। দেশ জুড়ে দারুন বিতর্ক, কার কিপিং করা উচিত?

পাইলট, নাকি মুশফিক?

আমরা প্রথম আলো থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম ‘স্টেডিয়াম’ নামে অধুনা বিলুপ্ত ফিচার পাতায় পরষ্পরের সম্পর্কে পাইলট ও মুশফিকের মূল্যায়ন নিয়ে একটা বড় ফিচার করবো। দু জনকেই ফোন দিলাম। দু জনই সময় দিলেন পরদিন মিরপুর স্টেডিয়ামে।

আমি একটা যুদ্ধ কাভারের মানসিকতা নিয়ে মিরপুর গেলাম। কল্পনা করছিলাম, তারা পরষ্পরকে দেখে মুখ কালো করে ফেলবেন, আড়ষ্ট উত্তর দেবেন এবং কোনোক্রমে উত্তর দিয়ে উঠে চলে যাবেন।

আমি যে তখনও শিক্ষানবীশ এবং দুনিয়ার কিছুই জানি না, তার প্রথম প্রমাণ পেয়েছিলাম সেদিন। মাঠে ঢুকে দেখি, পাইলট ভাই মুশফিকের কাধে ভর দিয়ে একটা পা ভাজ করে দাড়িয়ে আছেন। দু জন এক মনে কম্পিউটার এনালিস্ট নাসু ভাইয়ের কথা শুনছেন; এখনও জাতীয় দলের সাথে থাকা নাসির আহমেদ নাসু নিজে পাইলটপূর্ব যুগের দেশসেরা উইকেটরক্ষক। নাসু ভাই, পাইলট ভাই এবং মুশফিক; তিন জনকে একসাথে দেখে একটু চমৎকৃত হলাম।

আমার চমকের আর শেষ হয় না।

নাসু ভাই বললেন দু জনকে প্র্যাকটিসে যেতে। সেই প্র্যাকটিসটা আমার জন্য একটা শিক্ষা সফরের মতো ছিলো। পাইলট কিপিং প্র্যাকটিস করাচ্ছেন মুশফিককে; যে মুশফিক তাকে জাতীয় দল থেকে ছিটকে দিতে চলেছেন। রাবারের ব্যাট দিয়ে পাইলটের আঘাত করা বল ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে গ্লাভসে নিচ্ছেন মুশফিক। একটা বল মিস করায় শক্ত একটা ঝাড়িও দিলেন পাইলট।

লম্বা অনুশীলন শেষ করে দু জন হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন। পাইলট ভাই আমাকে চিনতেন। এক গাল হেসে বললেন, ‘আসো, দেবুদা। ইন্টারভিউ দেই। আসো, দু জনের মধ্যে যুদ্ধ লাগাও।’

এই হলেন খালেদ মাসুদ পাইলট। সদাহাস্যময়, সকলের প্রিয় এবং তার সময়ের সেরা পাইলট।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট অধিনায়ক এবং এক দশকেরও বেশী সময় ধরে বাংলাদেশের সেরা উইকেটরক্ষক ছিলেন খালেদ মাসুদ। মূলত ব্যাটিংয়ে এগিয়ে থাকার কারণেই নাসির আহমেদ নাসুকে রিপ্লেস করতে পেরেছিলেন। তবে বাংলাদেশের খেলোয়াড়ী জগত তাকে মনে রাখবে একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে, যিনি দেখাতে পেরেছিলেন যে কঠোর পরিশ্রম দিয়ে কিছু অর্জন করা যায়।

তার কঠোর পরিশ্রমই পাইলট ডাক নামের এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে এক দশকের বেশী সময় ধরে নির্বাচকদের এক নম্বর পছন্দে পরিণত করে রেখেছিলো। ৭ নম্বরে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ছিলেন। বাংলাদেশের বহু ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর একমাত্র সৈনিক হিসেবে লড়াই চালিয়ে গেছেন।

তবে পাইলটের জনপ্রিয়তার শুরু হয় ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি থেকে। কেনিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে একটা স্লগ করে ছক্কা মেরে তিনি অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এরও দু বছর আগে তার জাতীয় দলে অভিষেক হয়। বাবা ছিলেন দেশের নামকরা জাতীয় ফুটবলার-সামসুল আলম মোল্লা। রাজশাহী থেকে উঠে এসে এই পরিশ্রমী অ্যাথলেট বাবার পথে ফুটবলে না গিয়ে বেছে নেন ক্রিকেটকে। প্রথম নজর কাড়েন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। এরপর আবাহনী ও মোহামেডান দুই দলেই উইকেটের পেছনে ও সামনে তার পারফরম্যান্স নির্বাচকদের মুগ্ধ করে ফেলে।

আইসিসি ট্রফির পারফরম্যান্স তাকে জাতীয় দলে নিয়মিত করে ফেলে। যদিও উইকেটের পেছনে তার পারফরম্যান্স নিয়ে কোনো প্রশ্ন কখনোই ছিলো না। কিন্তু ব্যাট হাতে লম্বা একটা সময় রাণখরায় ভুগেছেন এই সময়। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে নিজেকে খুজে পেতে শুরু করেন। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিফটি করেন। তবে ইস্ট লন্ডনে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তিন ঘন্টা সংগ্রাম করে যে ৩৩ রানের ইনিংসটা খেলেছিলেন, মানুষ সেটাকেই বেশী মনে রেখেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাড়ে পাচ ঘন্টা ব্যাটিং করে পেয়েছিলেন নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।

বাংলাদেশের হয়ে ৪৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। ১৪০৯ রান করেছেন। একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০৪ সালে বিখ্যাত সেই ড্র করার ম্যাচে। ১২৬টি ওয়ানডেতে ১৮১৮ রান করেছেন। টেস্টে ব্যাটিং গড় ১৯.০৪ এবং ওয়ানডেতে ২১.৯০।

এই পরিসংখ্যান দিয়ে পাইলটের ব্যাটিং বীরত্ব বুঝতে পারবেন না। প্রায়শ দ্রুত টপ ও মিডল অর্ডার ধ্বসে পড়ার পর কিভাবে তিনি বাংলাদেশের মান বাচানো এক একটা ইনিংস খেলতেন, সেটা কেবল স্বাক্ষীরা মনে করতে পারবেন। পরিসংখ্যানে ঠাই না হলেও দেশের ক্রিকেট ইতিহাস মনে রাখবে তাকে।

অধিনায়ক হিসেবে তার দুটো রূপ। একদিকে প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন খেলোয়াড় ও দর্শকদের মধ্যে। ফলে দলটাতে প্রকৃত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সাফল্য বলে কিছুই পাননি। বরং ২০০৩ বিশ্বকাপের ভয়াবহ অভিযান তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে।

পাইলটকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছিলো তুলনামূলক ভালো ব্যাটিং করতে পারা মুশফিকুর রহিমকে। যদিও কিপার হিসেবে পাইলটের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে মুশফিক। তবে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই ফিফটি করার পর মুশফিককে আর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি।

পাইলট একজন ক্রিকেটার হিসেবে যেমন স্মরনীয়, তেমনই রাজশাহীর ক্রিকেটের জন্য তার অবদানও তাকে স্মরনীয় করে রাখবে। এই বিভাগীয় ক্রিকেট দলের অনুশীলন করানো, একটি পরিবার করে তোলায় তিনি ছিলেন পথিকৃত। এখনও অ্যাকাডেমি করে সেখান থেকে ক্রিকেটার তৈরী করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

পাইলটকে হয়তো তথাকথিত ইতিহাস বড় একটা অধ্যায় ছেড়ে দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই নামটি তো মনে রাখতেই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link