মার্টিন ওডেগার্ড, দলবদলের অন্দরমহল থেকে

সাত মৌসুম আগে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়েছিলেন এক ১৫ বছর বয়সী ছোকড়া। নরওয়ে থাকা আসা তারকার নামের প্রথম অক্ষরটাও ভিন্ন। আসার পর থেকেই তাকে লেবেল করা হইয়েছে রিয়ালের ভবিষ্যৎ হিসেবে। ৭ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়া, ডাচ লিগ, স্প্যানিশ লিগ ঘুরে নিয়ে এসেছেন অভিজ্ঞতা। রিয়ালের জার্সি গায়ে মাঠে নামার জন্য একেবারে প্রস্তুত। রিয়ালও আশাবাদী ছিল তাদের ৭ বছরের ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে। সাধারণত অধৈর্য্য রিয়াল ম্যানেজমেন্ট কাউকেই এতোটা সময় দেয় না যতটা না দিয়েছে তাকে। সবমিলিয়ে মার্টিন ওডেগার্ড রিয়ালের পারফেক্ট ইয়াং প্রডিজি। কিন্তু হুট করে তাকে লোনে পাঠিয়ে দেওয়া কি সঠিক সিদ্ধান্ত রিয়ালের জন্য? নাকি ওডেগার্ডের নেওয়া সেরা সিদ্ধান্ত?

স্প্যানিশ লিগে মানিয়ে নেওয়ার জন্য গত মৌসুমে তাঁকে রিয়াল সোসিয়াদাদের কাছে ধারে দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ২ বছরের লোনে প্রথম বছরই তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ওডেগার্ড। এই ওডেগার্ড যে আর ছোট্টটি নেই, তিনি এখন ডিফেন্স ভাঙ্গতে, গোল করতে প্রস্তুত তাঁর উদাহরণ রাখছিলেন পুরো মৌসুমজুড়ে। এক ওডেগার্ড আর ওয়ারজাবাল মিলে বদলে দিয়েছিলেন সোসিয়াদাদকে। বাস্ক ক্লাব সোসিয়াদাদ যেখানে মিডটেবিলে গড়াগড়ি খেত, তাদের সুযোগ করে দিয়েছেন ইউরোপা লিগে।

অন্যদিকে হ্যাজার্ডের ইনজুরি, মড্রিচের ফর্ম পরে যাওয়া, সব মিলিয়ে কোভিড আক্রান্ত রিয়ালের মৌসুম ছিল সম্পূর্ণ উলটো। ভরসা করার মতো কোণ পাত্রই যেন ছিল না তাদের কাছে। ফলে দুই মৌসুমের লোন ডিল ক্যান্সেল করে এক মৌসুমের মাথায়ই তাকে ফেরত নিয়ে আসে রিয়াল। জিদানের গ্রিন সিগনাল পেয়ে একেবারে মূল দলেই ঢুকে যান ওডে।

ওডেগার্ডের মৌসুমটাও ভালই যাচ্ছিল, স্বপ্নের দলে সাত বছর পর নেমে নিজেকে প্রমাণ করতে উন্মুখ হয়ে ছিলেন। তাঁর প্রভাব খেলাতেও পরেছিল। কিন্তু বেরসিক চোট তাঁর স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে হয়ে উঠছিল বাঁধা। তাঁর উপর রিয়াল মিডফিল্ড ট্রিওর অসাধারণ দর্ম। তা সত্ত্বেও ওডেগার্ডের উপর ভরসা করে তাকে মিনিট দিচ্ছিলেন জিদান। ডিসেম্বরে চোট পাওয়ার আগে মাত্র দুই ম্যাচে তাকে মাঠে নামাননি জিদান। ওডেগার্ড অবশ্য তেমন পার্থক্য গড়তে পারেননি, তবে রিয়ালের খেলার স্টাইলে বেশ পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন বটে।

কিন্তু চোট থেকে ফিরেই জায়গা হারান ওডেগার্ড। রিয়ালের মৌসুম এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না, বরং যেটুকু সামাল দেওয়া গিয়েছে তাও এসেছে ক্রুস-মদ্রিচ-ক্যাসেমিরোর পুরো সময়টা মাঝমাঠ সামাল দিতে পারায়। ফলে তার সুযোগ মিইয়ে আসতে থাকে। পুরো জানুয়ারি তাকে বেঞ্চে বসে দেখতে হয়েছে হার। এমনকি সুপারকোপা ও কোপা দেল রে’র মতন ম্যাচেও।

তরুণ প্রতিভা খেলানোর জন্য যে ম্যাচগুলোকে বেছে নেন কোচেরা; সে একাদশে তো দূরে থাক, পিছিয়ে থাকার পরও বেঞ্চ থেকে মাঠে নামার সুযোগ পাননি ওডেগার্ড। যে কেউই স্বীকার করবেন, দলের বিপদে ওডেগার্ডের ডিফেন্সচেরা পাসই হতে পারতো ম্যাচের ডিসাইডার। কিন্তু সেখানে জিদান তাকে ভরসা করেননি বিন্দুমাত্র। ফলে অধৈর্য্য হয়ে ওডেগার্ড বোর্ডকে বলেছেন নতুন দল খুঁজতে। রিয়ালও না করেনি, আরও এক বছর বড় দলে খেলএ যদি এক্সপেরিয়ান্স নিয়ে আসতে পারে তাতে ক্ষতি কী?

ওডেগার্ডকে নেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল অনেক দলই। কেনই বা হবে না? ইয়াং ট্যালেন্টদের মধ্যে ওডেগার্ডের মতন হাইপ এবং ডেলিভার কোনোটাই করতে পারেনি কেউ। আগের মৌসুমে খেলে আসা সোসিয়াদাদ, ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান আর ইংলিশ আর্সেনাল এগিয়ে ছিল দৌড়ে। শেষ পর্যন্ত ইংলিশ ক্লাবকেই বেছে নিয়েছেন ওডে। ওডেগার্ডের আর্সেনাল সিলেক্ট করার ব্যপারটা ইন্টারেস্টিং। সোসিয়াদাদ তার চেনা পরিচিত জায়গা, পুরাতন দল, পুরাতন কোচ, খেলোয়াড় হিসেবেই নতুন কারো আগমণ ঘটেনি। এতোসব পরিচিত জায়গা ছেড়েও কেন আর্সেনালে যোগ দিলেন ওডেগার্ড? যেখানে তারা নিজেরাই যাচ্ছে বড়সর একটি রিবিল্ডিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে?

উত্তরটা আছে তাদের কোচের নামে, মিকেল আর্টেটা। স্প্যানিশ কোচ ছিলেন সরাসরি গার্দিওলার ছাত্র। ম্যানচেস্টার সিটিতে তাঁর সহকারী কোচ ছিলেন প্রায় দেড় বছর। তাই ‘নাম্বার টেন’ কীভাবে খেলাতে হয় তা খুব ভালোমতই জানেন তিনি। এই কারণেই সম্ভবত মিলান সোসিয়াদাদ থেকে ওডেগার্ড বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন আর্সেনালে আসতে। তার উপর ওজিলের চলে যাওয়া ও এমিলি স্মিথের উঠে আসার কারণে বেশ ভালো পরিমাণ সময়ও পাবেন তিনি। ফলে সবদিক ভেবে ওডেগার্ডের সিদ্ধান্ত খুব একটা খারাপ না। কিন্তু তা কাজে আসবে তো?

খেলার ধরণের দিক থেকে ওডেগার্ড অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের থেকেই একটু আলাদা। ওডেগার্ড একজন পিউর ‘নম্বর টেন’। ফুটবল বিশ্বে এমন ট্যালেন্টদের কদর অনেক, কিন্তু কাজে লাগানোড় মতন কোচের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমান ফুটবলে ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক না করলে একাদশে জায়গা পাওয়াই কঠিন। ওডেগার্ড সেদিকে পটু বলেই বিভিন্ন দলে ভালো সময় পেয়েছেন। আর্টেটা তাঁর খেলার স্টাইল পরিবর্তন করবেন নাকি তাকে কেন্দ্র করে আর্সেনালের স্টাইল পরিবর্তন করবেন, সেটাই ছিল দেখার বিষয়।

প্রিমিয়ার লিগে আর্টেটা সরাসরি গার্দিওলার ছাত্র। পজিশনাল প্লে আর ক্রসিং ট্যাক্টিসই তাঁর প্রিয়। স্ট্যাটিসটিকসও ঠিক সে কথাই বলছে, প্রিমিয়ার লীগ আর ইউরোপা লীগ, দুইটাতেই আর্সেনাল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রস দেওয়া টিম। আর থ্রু-বলের তালিকায় পাঁচের বাইরে। গোল এবং শট ক্রিয়েশনে আর্সেনাল ১০ এর বাইরে। এই মৌসুমে আর্টেটা আর্সেনালকে একটা ধরাবাঁধা নিয়মে আনতে ক্রমাগত ৪-২-৩-১ ফর্মেশন ট্রাই করে যাচ্ছে।

ফলাফল খুব একটা আসছে তা নয়, কিন্তু দল দাঁড়া হচ্ছে। ‘নম্বর টেন’ হিসেবে ‘জোন ১৪’-এ খেলতে পারা খুবই বড় একটা বিষয়। গত দুই ম্যাচে সেই জায়গাতেই সুযোগ পেয়েছেন ওডে, যদিও কিছু করে দেখাতে পারেননি, কিন্তু সুযোগ আসছে। ক্রিয়েটিভিটিতে ভংগুর আর্সেনালের কাছে মানিয়ে নিতে পারা ওডেগার্ডই বড় অস্ত্র। এবং ওডেগার্ডের সামনেও সুযোগ রিয়াল ছেড়ে ছয় মাসের জন্য এখানে আসা যেন কোনো ফ্রি ট্রিপ না হয়। প্রমাণ করতে এসে যেন প্রমাণ করেই যেতে পারেন।

আর্সেনালের জন্য এই মাসটা নিজেদের প্রমাণ করার মাস। প্রিমিয়ার লিগ থেকে অন্তত ইউরোপা লিগ খেলতে হলে তাদের থাকতে হবে ৬ নম্বরে। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ যেতে হলে জিততে হবে ইউরোপা লিগ। ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে ওডেগার্ডের অভিষেক ইতিমধ্যে শেষ। প্রথম ম্যাচে ৬ মিনিট আর পরের ম্যাচে ২৫ মিনিট খেলেও তেমন কোণো প্রভাব ফেলতে পারেননি। প্রথম ম্যাচে ১ পয়েন্ট নিয়ে ফিরলেও পরের ম্যাচে কোনো কাজেই আসেনি তাঁর ধার। স্পেন থেকে ইংল্যান্ড গিয়ে মানিয়ে নিতে সামান্য সমস্যা হচ্ছে বৈকি, কিন্তু মানিয়ে নিতে পারলে লন্ডনের ক্লাবটার সাথে বেশ মানিয়ে নিতে পারবেন তিনি।

সমস্যা হচ্ছে সময়টা বড্ড অল্প। দ্রুত মানিয়ে নিতে না পারলে আবারও জিদানের হাতে গিয়েই পরতে হবে তাকে। জিদান ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’; প্রমাণ না করতে পারলে রিয়াল একাদশে সুযোগ পাওয়া আবারও অমাবস্যার চাঁদ হয়ে উঠবে ওডেগার্ডের জন্য। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে ওডে ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিতে যাবেন না নিশ্চয়ই?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link