মাস্টার ফ্রম চট্টগ্রাম

সম্ভবত সুজন ভাই প্রথম তাঁর কথা বলেছিলেন।

নাফিস ইকবালের একটা ছোট ভাই আছে। সে এখন ডিওএইচএসে খেলছে। খুব পিটিয়ে খেলতে পারে। তখন চারদিকে নাফিস ইকবালকে নিয়ে খুব হৈ চৈ ছিল। বলা হচ্ছিল, তাঁর এই ছোট ভাইটা নাফিসের মতো নয়।

এটুকুই জানতাম।

আমরা আর খুব বেশি খোঁজ রাখিনি। আমরা জানতেই পারিনি। ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশে একজন কিংবদন্তী তৈরী হচ্ছে ক্লাবের মাঠে। আমরা বুঝতেও পারিনি যে, চট্টগ্রাম থেকে উঠে আসছেন আরেকজন মাস্টার, আরেকজন খান। হ্যাঁ, তামিম ইকবাল খান।

বিখ্যাত ক্রীড়া সংগঠক এবং চট্টগ্রামের খেলাধুলার প্রবাদ পুরুষ ইকবাল খানের ছোট পূত্র তামিম ইকবাল। বাংলাদেশের কিংবদন্তী আকরাম খানের ভাতিজা তামিম ইকবাল। টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান নাফিস ইকবালের ছোট ভাই তামিম ইকবাল। কিন্তু সময়ের এমনই কৃতিত্ব যে, এই সব পরিচয় ম্লান হয়ে তিনি এখন বাংলাদেশের ইতিহাসের সফলতম ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল খান।

এখন বাকিরা সব তামিমের পরিচয়ে পরিচিত।

তামিমের উত্থানটাই ছিল হৈ চৈ করে। যুব বিশ্বকাপে দারুন পারফরম্যান্স করে এলেন। এরপর ডিওএইচএসের হয়ে ১৮৮ রানের ইনিংস; যেটা দীর্ঘকাল বাংলাদেশের লিস্ট-এ এর সর্বোচ্চ রান ছিল। রানের ফোয়ারা ছোটাতে থাকা তামিম ডাক পেলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ২০০৭ বিশ্বকাপের আগের ঘটনা।

চারদিকে শোরগোল উঠলো-ফারুক নিশ্চয়ই স্বজনপ্রীতি করেছেন!

নিজের ভায়রা ও অন্যতম নির্বাচক আকরামের এই ছোট ভাতিজাকে নিশ্চয়ই তিনি ‘চাচার জোরে’ দলে ডাকলেন। শোরগোলটাকে থামিয়ে দিয়ে উল্টো মিছিল তৈরী হতে সময় নিলেন না সেদিনের সেই পিচ্চি ভাতিজা।

ভারতের বিপক্ষে এক ফিফটি, জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেট এসে মারা এক ছক্কা এবং এক বিশ্বকাপ নাটকীয়তা দিয়ে উত্থান হলো একজন তামিম ইকবালের। বাংলাদেশ পেলো এক মহাতারকা।

সেই উত্থানের পর ঠিক ১৪ বছর পার হয়ে গেছে। তামিম ইকবাল এখন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে দেড় দশকে পা রাখলেন।

এই দশ বছরে বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্র বদলে গেছে। লোকে এখন নাফিস ইকবালকে ‘তামিমের বড় ভাই’ বলে চেনে। লোকে এখন আকরাম খানকে ‘তামিমের চাচা’ বলে চেনে।

তামিম এখন পিচ্চি থেকে দলের সিনিয়র খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। তামিম এখন সব ফরম্যাটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হয়েছেন। বুমবুম থেকে শুরু করা তামিম এখন পরিণত এক ব্যাটসম্যান, পরিবর্তিত টেকনিকে সেই তামিম এখন দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক ভরসার নাম।

তবে, একটা জিনিস বদলায়নি-তামিমের প্রতি মানুষের বিকট এক সমালোচনাপ্রবণতা।

তামিম যে কোনো অধিনায়কের জন্য খুব পছন্দের একজন খেলোয়াড় হওয়ার কথা। ক্রিকেট অধিনায়ককে শুধু মাঠে খেলা পরিচালনা করলে চলে না, মাঠের বাইরে দলের বাকি ১৪-১৫ জন খেলোয়াড়ের মনোজগৎ নিয়ে খেলতে হয়। কাউকে ধমক দিলে সেরাটা বের হয়, কাউকে একটু আনন্দ দিলে সেরাটা পাওয়া যায়।

তামিম ইকবাল অধিনায়কের জন্য কাজটা সোজাই করে রেখেছেন। তিনি বলেন, তার সেরাটা বের করে আনতে একটু প্রশংসা করলে চলে। তার চাই একটু পিঠ চাপড়ে দেয়া। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক যেই থাকুন, তামিমকে পিঠ চাপড়ে দিতে কসুর করেন না; তামিম সেটার যোগ্যও।

কিন্তু তামিম ইকবালের কপালটাও সে রকম। যে জায়গা থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশী ভালোবাসাটা আশা করে, সেই দর্শককুল কেনো যেন অকারণেই তাকে বড় নিষ্ঠুর ভাষায় সমালোচনা করেন।

পিঠ চাপড়ানোর বদলে অধিকাংশ সময় ধমক আর সমালোচনাই জোটে তার কপালে।

কিন্তু মুশকিলটা হলো, পর পর দু-তিনটে ইনিংস খারাপ করলেই দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় তামিমকে নিয়ে নিন্দার ঝড়, সমালোচনার উৎসব।

আজ সাফল্য আসছে বলে হয়তো সমালোচনাটা বন্ধ আছে। কিন্তু তামিম জানেন, সেটা কেবল ঘুমিয়ে আছে। আবার একটু ব্যর্থ হলেই শুরু হবে। তামিম বলেন, সেটা তিনি মেনেও নেবেন। তবে তার অনুরোধ একটাই, তার পরিবারকে যেন এই সমালোচনার মধ্যে টানা না হয়, ‘ক্রিকেট খেলাটা একটা চক্রের মতো। কখনও কেউ ভালো খেলতে থাকবে, আবার খারাপ সময় আসবে। খারাপ করলে সমালোচনা হবে। কিন্তু গত কয়েক মাসে আমার খারাপ পারফর্মেন্সের জন্য আমার পরিবারের সদস্যদের অনেক খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। মাঠে আমি ব্যাট করি, আমার পরিবার নয়। আমি আপনাদের মাধ্যমে সবাইকে অনুরোধ করবো আবার খারাপ সময় এলে আমাকে যা বলার বলবেন, আমার পরিবারকে দয়া করে এর মধ্যে টানবেন না।’

দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানটিকে আমরা প্রাপ্য সম্মানটা দিতে না পারি, এটুকু অনুরোধ রাখাও কী খুব কঠিন?

তামিম ইকবালের সবকিছু আমারও পছন্দ না। তার ইদানিংকালের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং আমার পছন্দ না। তিনি স্ট্রাইকরেট নিয়ে কথা শুনতে পছন্দ করেন না; আমি বলতে পছন্দ করি। তাই বলে তামিম যে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান, সেটা কী ভুলে গেলে চলবে? চলবে না বলেই তার সমালোনা করার সময়ও শ্রদ্ধাটা বজায় রাখতে হবে।

এই ১৪-১৫ বছরে আর কিছু না হোক, তামিম যা অর্জন করেছেন, তাতে এই শ্রদ্ধাটা তার প্রাপ্য। আমরা বারবার তামিমের কাছে ক্ষমা চাইবো এবং স্বীকার করে নেবো, তিনি আমাদের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান। তামিমের জয়যাত্রা চলতে থাকুক। তবে, সব সুন্দর যাত্রারই হয়তো শেষ আছে। তামিমও হয়তো সেটা বুঝে সুদিন থাকতে থাকতেই বিদায় বলে দিবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link