যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায়, যেভাবেই হোক!

জেমস অ্যান্ডারসনের কোনো কিছুতেই আর বিস্ময় প্রকাশ করার সুযোগ নেই। ৬০০ উইকেট, ১৫০ টির বেশি টেস্ট খেলার কীর্তি – তিনি তো আর কম অভিজ্ঞ নন। অনেকরকম জুতোয় ক্যারিয়ার জুড়ে পা গলিয়েছিন তিনি। এরপরও চেন্নাই টেস্টের পঞ্চম দিনে নতুন করে চেনা গেল তাঁকে। আর সেটা এতটাই যে, স্বয়ং আম্পায়র নিতিন মেননের চোখও ছানাবড়া হল।অ্যান্ডারসন স্মরণীয় এক স্পেল উপহার দিলেন, ভারতের মাটিতে স্মরণকালের অন্যতম সেরা জয়ের দেখা পেল ইংল্যান্ড। এই জয়, এই স্পেলটা ভুলবার নয়।

টেস্ট ক্রিকেটে অপ্রতিরোধ্য এক দল ভারত। বিশেষ করে ঘরের মাঠে ভারতকে হারানো যেনো প্রায় অসম্ভব। ২০১২ থেকে ঘরের মাঠে কোনো টেস্ট হারেনি ভারত। এমনকি দেশের মাটিতে খেলা শেষ ৫০ ম্যাচে ওদের হার মাত্র চারটিতে। সেই অপ্রতিরোধ্য ভারতের বিপক্ষেই মাঠে নেমেছিলেন জেমস অ্যান্ডারসন।

উপমহাদেশের কন্ডিশনে তিনি সব সময় মানিয়ে নিতে পারেন না –  এই দুর্নাম তো ছিল। আর তার ওপর চেন্নাই টেস্টেও ভারত এগোচ্ছিল সুপরিকল্পিত ভাবেই। প্রথম ইনিংসে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডকে অল আউট করে দেয় মাত্র ১৭৮ রানে।

রবিচন্দ্রন আশ্বিন নেন ৬ উইকেট। ৫৮ রানে রোহিত শর্মা ও পূজারার উইকেট হারালেও ভিরাট কোহলির সাথে শুভমান গিলের জুটি ম্যাচকে প্রায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। ভারতের সংগ্রহ যখন ৯২ রান তখন ২৭ তম ওভারে বোলিংয়ে আসেন জেমস অ্যান্ডারসন।

হয়তো টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্বরণীয় ওভারটি করতেই এসেছিলেন তিনি। গিলের উদ্দ্যেশে ছোড়া প্রথম বলটিতে খানিকটা রিভার্স স্যুইংয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এবার আর আভাস নয়। দ্বিতীয় বলটি পুরোপুরি রিভার্স স্যুইং করে গিলের অফ স্ট্যাম্প চেন্নাইয়ের হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন অ্যান্ডারসন।

তৃতীয় বলটি নতুন ব্যাটসম্যান আজিঙ্কা রাহানে দেখেশুনে ছেড়ে দেন উইকেটরক্ষকের জন্য। তবে চতুর্থ বলে ইন সুয়ং করে ভিতরে ঢোকা বলটি রাহানের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে প্যাডে আঘাত করে। ইংল্যান্ড জোরেশোরে আপিল করলেও তাতে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নেয় ইংল্যান্ড তবে সে যাত্রায় রক্ষা পান রাহানে।

কিন্তু, পরের বলে আর আম্পায়ারকে কোনো ভূমিকায়ই রাখতে চাননি অ্যান্ডারসন। এবার ভারতের সহ-অধিনায়কের স্ট্যাম্প উপড়ে ইংল্যান্ডকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণে এনে দেন অ্যান্ডারসন। সাম্প্রতিক সময়ে এতটা বিধ্বংসী ওভার টেস্ট ক্রিকেটে আর কেউ কি করেছেন? – প্রশ্ন আসতেই পারে।

টেস্টের ইতিহাসে এমন ওভারে সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, ব্রিজটাউনে মাইকেল হোল্ডিং, করাচিতে ইরফান পাঠান – সবগুলোকে এবার অ্যান্ডারসন ছাড়িয়ে যেতে পারেননি কেবল দর্শকস্বল্পতায়। তা না হলে, নি:সন্দেহে উত্তেজনা আরো বাড়তো।

৩৮ বছর বয়সেও এই যে তিনি কতটা বিধ্বংসী হতে পারেন তার প্রমাণ আবারও পাওয়া গেল। হোক তা ইংল্যান্ডের পেস বান্ধব উইকেট কিংবা উপমহাদেশর পঞ্চম দিনের উইকেট। তিনি সবখানে,সমসময়ই, সমানভাবে কার্যকরী।

অ্যান্ডারসন বললেন, ‘স্ট্যাম্পকে বাতাসে ভাসতে দেখলে কার না ভাল লাগে, আর আমার যে বয়স তাতে সেটা আর রোজ রোজ করা সম্ভব নয়। তাই, আমি খুশি। তবে, সবচেয়ে বেশি খুশি টেস্টের পাঁচদিন জুড়ে পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা রাখতে পেরে।’

তাঁর ১১ ওভারের স্পেলটিই বুঝিয়ে দেয়। মাত্র ১৭ রান দিয়ে তুলে নেন মূল্যবান তিনটি উইকেট। এছাড়া বিরাট কোহলিকেও বেশ চাপে রেখেছিলেন এই পেসার। ইংল্যান্ড দলও অন্য বোলারদের ওভারে সিঙ্গেল নিতে দিয়ে বারবার কোহলিকে অ্যান্ডারসনের মুখোমুখি করাতে চাচ্ছিল।

অ্যান্ডারসনকে সবসময় শুধু ইউরোপের মানে ইংল্যান্ডের পিচেই গুরুত্ব দেয়া হলেও তিনি যে উপমহাদেশেও সমানভাবে বিপদজনক তা আজ প্রমাণ করলেন। তার পরিসংখ্যানও সেই কথাই বলে। উপমহাদেশে প্রায় ২৭ গড়ে ২৪ টেস্টে তিনি তুলে নেন ৭১ টি উইকেট। যেখানে ইউরোপে তাঁর গড় প্রায় ২৪। সেখানে ৮৯ টেস্টে তিনি নেন ৩৮৪ উইকেট।

চেন্নাইয়ের তপ্ত দুপুরে রুটবাহিনী যখন বিজয় উদযাপন করছে, ইংল্যান্ডে তখন বরফ পড়ছে। কেউ কেউ হয়তো শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে বসেই জয় দেখেছেন, ‍উপভোগ করেছেন। কিন্তু বিস্মিত হননি। অ্যান্ডারসনকে দেখে আর চমকে ওঠার কিছু নেই!

 

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link