কিংবদন্তিরা দেখতে কেমন?
এই যে, ঠিক এই ছবির মতো!
৫০০ উইকেট, ৬০০ উইকেট, এসব একসময় আমাদের ক্রিকেটে ছিল দূর আকাশের তারা। রাজ মুঠোয় ভরে দেখিয়েছেন।
বয়স যখন ৩০ হয়ে গেছে, তখনও প্রথম শ্রেণিতে ২০০ উইকেট ছিল না রাজের। ৩০ পেরোনোর পর নিয়েছেন ৪৩৭ উইকেট। আমাদের ফাইন ওল্ড ওয়াইন।
পরিসংখ্যানে এমন নান্দনিক আঁকিবুকি কম নেই আবিরেরও। ২২ গজে দুজনের ব্যাট-বলের ঝংকার রেকর্ড বইয়ে তোলে গর্জন। জানান দেয় তাদের বিশালত্বের।
স্বীকৃত ক্রিকেটে ১১৪৫ উইকেট রাজের। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবিশ্বাস্য সংখ্যা। ১ হাজার উইকেটও নেই আমাদের আর কারও (সাকিবের ৯৯৭)। ৫ উইকেট নিয়েছেন মোট ৫০ বার। ১১ বার ম্যাচে ১০ উইকেট।
সঙ্গে তার রানও আছে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি। অনেকের হয়তো মনেও থাকে না, আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে বাংলাদেশের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডও রাজের (২১ বলে, যৌথভাবে)।
আবির করেছেন ১৪ হাজার ৬৫৮ রান। সেঞ্চুরি ২৫টি। তিন ফরম্যাটেই পেয়েছেন তিন অঙ্ক ছোঁয়ার স্বাদ।
তবে এসব সংখ্যার ঝনঝনানিতে শুধু নন, তারা কিংবদন্তি অন্য জায়গায়ও। যেটির নাম ‘নিবেদন’। নিবেদন তো দেশের ক্রিকেটে কতজনের কতভাবেই আছে। তবে এই দুজনের নিবেদন স্পেশাল, কারণ দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে অবহেলিত জায়গাটিতেই তাদের নিবেদন ছিল সবচেয়ে বেশি। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট!
এই ঊষর ভূমিতে তারা সোনা ফলিয়েছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। তাচ্ছিল্যের এই জায়গাই ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে দামি। আড়ালের এই আঙিনায় তারা আলো ফেলেছেন বারবার।
জাতীয় লিগ, বিসিএলকে যে গুরুত্ব, পেশাদারিত্ব, আবেগ ও ভালোবাসায় তারা দেখেছেন ও খেলেছেন, এই জায়গাটায় দেশের সব ক্রিকেটারের জন্য, জাতীয় দলের ভেতরে-আশেপাশে-বাইরের ক্রিকেটার, উঠতি-লড়াইয়ে থাকা-প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার কিংবা স্বপ্নাতুর চোখে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে থাকা কিশোর-তরুণ, সবার জন্য উদাহরণ এই দুজন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুজনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-আক্ষেপ, হাসি-হাহাকারের গল্প লেখা আর বলা হয়েছে তো অনেক। আজকে আরেকবার আলতো করে ছুঁয়ে দেওয়া যেতে পারে।
আবিরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের অধ্যায়গুলোর একটি হয়ে রইবে আরও বহুদিন। ২০০৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দল থেকে বিতর্কিতভাবে বাদ পড়ার পর প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১৬ চারে ১০১ রানের ইনিংস, বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের খরার দেশে বাঁহাতি সৌন্দর্যের রোমাঞ্চ নিয়ে আবির্ভাব, লম্বা চুল আর শরীরী ভাষার দুঃসাহস, ফতুল্লার ঐন্দ্রজালিক ১৩৮, ৬ মাসের মধ্যে ৪টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির অবিশ্বাস্য অনুভূতি, এক বছরে হাজার ওয়ানডে রানের অভাবনীয় ধারাবাহিকতা। সব মিলিয়ে সেই সময়ের সাফল্য বুভুক্ষু আমরা কিংবা বাংলাদেশের ক্রিকেট, আবিরের কাছে অনেক ঋণে আবদ্ধ।
আইসিএলে না গেলে তার ক্যারিয়ারের গতিপথ কেমন হতো, সেই আলোচনা তোলা থাক অন্য কোনো সময়ের জন্য। আইসিএল থেকে ফেরার পর কিছু পারফরম্যান্স, কিছু হতাশা, সেসবও আজ বাদই থাকুক। আবির আমাদের কিংবদন্তি, এর পরের অধ্যায়ের জন্য।
২০১৩ সালে সবশেষ তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা। ২০১৪-১৫ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি ১ হাজার ৬৪ রান করেছেন ৬৪২৩ গড়ে। পরের মৌসুমে ১ হাজার ১১৭ রান ৬২.০৫ গড়ে। পরের মৌসুমে ৫৫.৮৭ গড়ে ৮৯৪ রান। ওই সময়টায় অন্তত একবার টেস্ট দলে ডাক না পাওয়া তার প্রতি ছিল অবিচার।
বোলিং অ্যাকশনের ত্রুটিতে রাজের ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যেতে পারত অনেক বছর আগেই। কিন্তু চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় নিজেকে শুধরে তিনি ফিরেছেন আরও ধারাল হয়ে, দোর্দণ্ড প্রতাপে। ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক, দ্রুততম ১০০ উইকেট, সবার আগে ২০০ উইকেট, বাঁহাতি স্পিনে ওয়ানডেতে ৪ বার ৫ উইকেটের বিশ্বরেকর্ড, কত কত কীর্তি তার!
অবিচারের শিকার হয়েছিলেন তিনিও। নইলে আরও অন্তত ৩-৪ বছর হয়তো খেলতেই পারতেন জাতীয় দলে।
তার পরও তার ক্যারিয়ার শুধু আক্ষেপের গল্প নয়, বরং অর্জনের প্রতিশব্দ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গত ৮ মৌসুমের ৬টিতেই রাজ উইকেট নিয়েছেন ৫০টির বেশি করে (বাকি দুই মৌসুমে ৪২ ও ৪৩ উইকেট)। এমনকি সবশেষ মৌসুমেও তার ছিল ৫৩ উইকেট।
এড়াতে চেয়েও পরিসংখ্যানের কপচানো অনেক হয়ে গেল। আসলে, এই সংখ্যাগুলোও তো তাদের নিবেদনের জীবন্ত স্বাক্ষী!
নিবেদনেই ফিরি আবার। প্রতিটি ঘরোয়া মৌসুম শুরুর আগে রোমাঞ্চ উত্তেজনা নিয়ে তাদের অপেক্ষা, খুলনা আর দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে রাজের এক দিনেই ২৫-৩০ ওভার বোলিং দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ, মৌসুমের পর মৌসুম নেতৃত্বে দলকে উজ্জীবিত করা আর ট্রফি এনে দেওয়া, আবিরের অফ মৌসুমের অনুশীলন, জাতীয় দলে ফেরার আশা ক্ষীণ জেনেও বোলিং মেশিন কিনে কসরত চালিয়ে যাওয়া, ঘরোয়া ক্রিকেটের সিস্টেম, সীমাবদ্ধতা আর প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে দুজনের লড়াই, দেশের ক্রিকেটের প্রতিটি দিন জানে তাদের নিবেদনের গল্প। জানে তাদের নিবেদনের মূল্য।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রতি তাদের যে মমতা, বাংলাদেশের ক্রিকেট এমন কিছু দেখেনি আগে।
সেই অধ্যায়, সেই ছুটে চলা আজ থেমে গেল আনুষ্ঠানিকভাবে।
থেমে যাওয়া মানেই সমাপ্তি নয়। দুজনেরই নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে ক্রিকেটের আঙিনায়। রাজ এখন জাতীয় নির্বাচক। আবির কাজ করবেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ডেপুটি অপারেশন্স ম্যানেজার হিসেবে।
বিসিবিতে আগেও নানা ভূমিকায় নানা সময়ে সাবেক ক্রিকেটারদের দেখা গেছে। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি অনেককে নিয়েই। রাজ্জাক ও শাহরিয়ারের সুযোগ আছে সেই ধারা বদলানোর, নিজেদের ছাপ রাখার, এখানেও আলাদা হয়ে ওঠার।
আপাতত, গৌরবদীপ্ত খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানার দিনটিতে, একজন ভক্ত হিসেবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ক্ষুদ্র অনুসারী ও অনুরাগী হিসেবে, দুজনকে জানাই কুর্নিশ আর এক আকাশ ভালোবাসা।
থ্যাংক ইউ লিজেন্ডস। ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য।
(তাদেরকে আমি ডাক নাম ধরে, রাজ ও আবির বলেই ডাকি। ব্যক্তিগত প্রোফাইলে ব্যক্তিগত ভাবনার লেখায় সেভাবেই রাখলাম। ঘরোয়া ক্রিকেটের একজন একান্ত অনুসারী হিসেবে তাদের খুবই আপনজন মনে করেছি সবসময়, করি। তাদের আর ঘরোয়া ক্রিকেটে দেখব না, এটি নিয়ে ক্রিকেট রিপোর্টার হিসেবে নিজের হাহাকারের জায়গাটা কাল-পরশু বা সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব)
* ফেসবুক থেকে