২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের গ্রীষ্মকালীন মৌসুম চলছে। আর একই সময়ে চলছিলো ২০১৪ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে চলছিলো জাতীয় যুব টুর্নামেন্ট। নিউজিল্যান্ড যুব দলের বোলিং কোচ ডেল হ্যাডলি কিছু ক্রিকেটারদের উপর নজর রাখছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাইল জেমিসন। ২.০৩ মিটার উচ্চতার এই পেসারের মধ্যে সম্ভাব্য সব কিছু ছিলো বয়স ভিত্তিক দল থেকে অন্য লেভেলের ক্রিকেট খেলার জন্য।
টেস্টে ইতিমধ্যে নিজেকে ভয়ানক বলে প্রমাণ করে ফেলেছেন জেমিসন। টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডেতে সেভাবে জ্বলে ওঠার আগেই আইপিএলের নিলামঘর কাঁপিয়ে ফেলেছেন এই তরুণ ফাস্ট বোলার।
সেদিন জেমিসনের ওপর নজর রাখা হ্যাডলি বলছিলেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম জেমিসন কতটা লম্বা। জেমিসনের বোলিং ঠিকই ছিলো। তাঁর মধ্যে বিশেষ কিছু ছিলো না। কিন্তু তারপরও সে ২০১৪ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলো। আমি তাকে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দেখেছিলাম। আর পুরো বিশ্বকাপে আমি ওর মধ্যে বিশেষ কিছু দেখেছিলাম দেখেছিলাম।’
বৃহস্পতিবার রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর তাকে কেনার চেষ্টা প্রমাণ করেছে সে কতটা প্রতিভাবান। ব্যাঙ্গালুরু তাঁর জন্য ১৫ কোটি রুপি খরচ করেছে। আইপিএল ইতিহাসের সবচেয়ে দামি কিউই ক্রিকেটার। এর আগে কখনো কোনো কিউই ক্রিকেটার আইপিএল নিলামে এতো দাম পাননি।
হ্যাডলি যখন তাঁকে প্রথম দেখেন কাইল জেমিসন ছিলেন একজন প্রতিভাবান পেসার। তিনি মনে করেন এখনো তাঁর বোলিংয়ে অনেক পরিবর্তনের অনেক প্রয়োজন আছে। হ্যাডলি বলেন, ‘তাঁর বোলিং রান আপে গতি কম। ক্রিজে যত দ্রুত বল করা প্রয়োজন সে সেটা করতে পারে না। তাই আমরা তার গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। দৌড় শুরু করার পর সে বোলিংয়ে এসে পায়ের উপর বেশি ভর দেয়। সে বোলিং লাইন আপের বরাবর দৌড়াতে পারে না। এই বিষয়ে তাঁকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো পায়ের উপর বেশি ভর দেয়া। যাতে সে আমনের পা দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা এটা নিয়ে অনেক কাজ করেছি। এমন কি এটা নিয়ে কাজ করার ফলে সে তাঁর গোড়ালিতে ব্যথা পেয়েছিলো। আর এটার ফলাফল খুব একটা ভালো ছিলো না।’
কাইল জেমিসন ধীর গতিতে জাতীয় দলে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে গত বছর ভারতের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে। তখন থেকে নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্টে নিয়েছেন ৩৬ উইকেট। তাঁর বোলিং গড় বিস্ময়কর ভাবে ১৩.২৭। জেমিসনের শক্তিশালী দিক হলো তিনি অনেক দ্রুত যেকোনো কিছু শিখতে পারে। তাঁর বোলিংয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো জেমিসন ভালো আউট সুইংগার করতে পারেন। সাথে মারাত্মক বাউন্সও করতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বোলিং ভান্ডারে নতুন একটি অস্ত্র যোগ করেছেন। সেটা হলো ইনসুংগার। আর এই ইনসুংগারেই আউট করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান রোস্টন চেজকে।
জেমিসনের ঘরোয়া লিগের দল অকল্যান্ডের কোচ হেনরিখ মালান বলছিলেন এই শীতে তারা জেমিসনের বোলিংকে আরো শক্তিশালী করতে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জেমিসনের আউটসুইংগার করার দক্ষতা ছিলো। আমরা সেটাকে আরো বেশি কার্যকরী করতে কাজ করেছি। আর এই বছর সেটা অনেক ভালোকাজ করছে। আর পাশাপাশি ইনসুংগার জেমিসনের প্রধান অস্ত্রে পরিণত হবে।’
কাইল জেমিসন তাঁর কোচ হেনরিখ মালানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। যাতে সে বোলিং এ ভালো করতে পারে। মালান জানান, ‘আমরা মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করতেছি। যাতে সে বিষয়গুলো নিয়ে কোনো অস্বচ্ছতা না থাকে। জেমিসনের খেলার ধরন নিয়ে কাজ করছি। যাতে তাঁর বোলিং অ্যাকশনের কোনো পরিবর্তন না করতে হয়। বায়োমেকানিক্যালি তাঁর অ্যাকশন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যাতে তাঁর অ্যাকশন বোঝা যায়। বায়োমেকানিকাল ভাবে কাজ করলে আপনার বোলিং অ্যাকশনের ছোটো পরিবর্তনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বোঝা যাবে। সে এই বছর তাঁর বর্তমান বোলিং অ্যাকশন নিয়ে খেলে যাচ্ছে। তাই আমরা এখন তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কোনো কাজ করতে চাচ্ছি না।’
হেনরিখ মালান আরো জানান, ‘বুঝতে পারছি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে এগিয়ে যাবে। খুব বেশি পিছিয়ে পড়বে না। তাই আমরা দুইটি মৌলিক বিষয়ে বেশি কাজ করতে চাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি জেমিসন যেন তাঁর গতি বাড়িয়ে পর্যাপ্ত মোমেন্টাম তৈরি করতে পারে। তাঁর পায়ের কাজ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যদি সে প্রতিনিয়ত এটা করতে থাকে তাহলে সে ভালো করতে থাকবে। এই বছর আমরা দেখেছি সে প্রায় দুই গজ বোলিং দূরত্ব বাড়িয়েছে। আর তাঁকে নিয়ে কাজ করার তৃতীয় জরুরী বিষয় হলো বোলিং এ বেশি বেশি স্কিল নিয়ে আসা।’
কাইল জেমিসন শুধু বড় ফরম্যাটের ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে না। সে নিজেকে ছোটো ফরম্যাটের ক্রিকেটের জন্যও প্রস্তুত করছে। ইতিমধ্যে সে ছোটো ফরম্যাটে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। ২০১৯ সালে তাঁর ঘরোয়া লিগের দল অকল্যান্ড এসেসের বিপক্ষে ৬ উইকেট নিয়েছিলো। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত আইপিএল নিলামে তাঁর অলরাউন্ডারিং পারফর্মেন্স সবার নজর কেড়েছে।
হেনরিখ মালান বলেন, ‘টি-টোয়েন্টি একটি আনন্দদায়ক খেলা, তাই না? ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট। এখানে আপনি মাত্র ২৪ বল বোলিং করার সুযোগ পাবেন। আর এর মধ্যেই আপনাকে ভালো করতে হবে। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খুব দ্রুত হয়। জেমিসন চায় সে নিউজিল্যান্ডের হয়ে সব ফরম্যাটে খেলবে। এটা খুব বেশি কঠিন হবে, কারণ পরপর দুই বছর দুইটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে।’
মালান ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলছিলেন, ‘জেমিসন টি-টোয়েন্টিকে কেন্দ্র করে বোলিংয়ের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। টি-টোয়েন্টিতে ইয়র্কার, স্ট্রেইট ইয়র্কার এবং ওয়াইড ইয়র্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে যদি চাপের মধ্যে নিয়মিত এই রকম এইগুলো করতে পারে, তাহলে তাঁর বোলিং খুবই কার্যকরী হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁকে যেন ব্যাটসম্যানরা ঠিকমত বুঝতে না পারে। অ্যাকশনের ব্যাপারে সে বেশ আত্মবিশ্বাসী, সে এটা এখন করতে পারে। কিন্তু একজন ক্রিকেটার এবং মানুষ হিসেবে প্রতিদিন উন্নতি করতে হবে।’
যদিও কাইল জেমিসন বোলার হিসেবে নজর কেড়েছেন। তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্যকে ছোটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। ইতিমধ্যে নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্টে তিনি নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। দলের খারাপ সময়ে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে সে ৪৯ রানের একটি ইনিংস খেলেছে। এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধ শতক করেছে জেমিসন। অকল্যান্ড দলের কোচ হেনরিখ মালান জানান, ‘লকডাউনে অকল্যান্ড দলের অন্য ক্রিকেটাররা ঘরে ছিলো। আর সেই সুযোগে প্রচুর বল কাইল জেমিসন প্রচুর বল করে নিজের উন্নতি করেছে। শুধু বোলিং নয়, ব্যাটিং এও উন্নতি করেছে সে। অকল্যান্ডে সে প্রচুর কাজ করেছে তাঁর কোচদের সাথে। ক্রিকেটের বিভিন্ন ফরম্যাট অনুযায়ী কাজ করেছে।’
এবারের আইপিএলে ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে সে তাঁর সব দক্ষতাই দেখাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে। ব্যাঙ্গালুরুর অধিনায়ক বিরাট কোহলি জেমিসনের সব ধরনের সুবিধা নিতে পারবে বলে মনে হয়।