‘তুমি নিজেকে এতটা নিচে নামাতে পারো না’
এই ছিল ব্রায়ান লারাকে পাঠানো ভিভ রিচার্ডসের বার্তা। অ্যান্টিগা টেস্ট শুরুর ঠিক আগে আগে। সেটি ২০০৪ সাল। ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম তিন টেস্টের ছয় ইনিংসে লারার রান ছিল সাকল্যে ১০০। দল হেরেছিল তিন ম্যাচই। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসছিল সমালোচনা।
লারা নিজেই বলেছিলেন, আরেকটি টেস্ট হারলে হয়ত অধিনায়কত্বই কেড়ে নেওয়া হবে। ক্যারিয়ার জুড়ে এভাবেই অসংখ্যবার সমালোচনার তিরে রক্তক্ষরণ হয়েছে তাঁর। তবে কোনোবারই রক্ষক্ষরণে কাহিল হননি, বরং বিন্দু বিন্দু জবাব দিয়েছেন। দু:সময়কে পাল্টা জবাব লারার মত করে দিতে পারেননি ক্রিকেটে আর কেউ। সেবারও দিয়েছিলেন। অনুপ্রেরণা ছিল ভিভের সেই বার্তা।
ওই মাঠের কিউরেটর তখন অ্যান্টিগারই আরেক কিংবদন্তি অ্যান্ডি রবার্টস। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সারথি তিনি, দলের হোয়াইটওয়াশ হওয়ার শঙ্কায় এমন উইকেট বানালেন, যেটি পাকা সড়কের চেয়েও নিষ্প্রাণ। কাঙ্খিত টস জিতলেন লারা।
ড্যারেন গঙ্গা আউট হওয়ার পর যখন উইকেটে গেলেন তিনি, ম্যাচের বয়স ঘন্টাখানেক। চতুর্থ বলেই জোড়ালো এক কট বিহাইন্ডের আবেদন থেকে বেঁচে যান স্টিভ হার্মিসনের বলে। একটা শব্দ মতো শোনা গিয়েছিল, সাড়া দেননি ড্যারিল হেয়ার।
এরপর আর সমস্যা হয়নি। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম দিন শেষে অপরাজিত ৮৬। দ্বিতীয় দিনেই সেঞ্চুরি ছুঁয়ে, ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে পেরিয়ে গেলেন ট্রিপল সেঞ্চুরি। দিন শেষে অপরাজিত ৩১৩। ইতিহাস হয়ে গেছে তখনই, ডন ব্র্যাডম্যানের পর প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দুটি ট্রিবল সেঞ্চুরি। তবে হাতছানি তখন আরও বড় কীর্তির!
তৃতীয় দিনে লাঞ্চের আগে-পরে দুদফায় লিখলেন নতুন ইতিহাস। মাত্র ছয় মাস আগেই টেস্টের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডটি হারিয়েছিলেন ম্যাথু হেইডেনের কাছে। লারার ৩৭৫ ছাড়িয়ে হেইডেন করেছিলেন ৩৮০। এবার লাঞ্চের একটু আগে ৩৭৪ থেকে অফ স্পিনার গ্যারেথ ব্যাটির বলে ডাউন দ্য উইকেটে ছক্কায় লারা স্পর্শ করলেন ৩৮০।
পরের বলেই সুইপ করে বাউন্ডারিতে আবারও সবচেয়ে উঁচু চূড়ায়। মাত্র ১৮৫ দিনেই হেইডেনের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন নিজের রেকর্ড। প্রথম রেকর্ড গড়ার ১০ বছর পর আবারও একই রেকর্ড গড়ে আরও একবার বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন নিজের বিস্ময়কর ব্যাটসম্যানশিপ!
থামেননি সেখানেই। ৩৯০ রান নিয়ে গিয়েছিলেন লাঞ্চে। লাঞ্চের খানিক পর সেই ব্যাটির বলেই সুইপ করে আরেকটি সিঙ্গেলে ৪০০। কমেন্ট্রি বক্সে বব উইলিস (সম্ভবত) বলেছিলেন, ‘পারহ্যাপস দা মোস্ট সিগনিফিকেন্ট সিঙ্গেল এভার ইন দা হিস্ট্রি অব টেস্ট ম্যাচ ক্রিকেট।’
টেস্ট ইতিহাসের প্রথম কোয়াড্রপল! ১২৭ রানে রান আউটের সিদ্ধান্ত গিয়েছিল থার্ড আম্পায়ারের কাছে। ২৯০ রানে সুইপ করতে গিয়ে একটু ক্যাচ মতো দিয়েছিলেন। ৩৭৩ রানে আরেকবার জোড়ালো কট বিহাইন্ডের আবেদন। এই তো। সত্যিকারের ‘লাইফ’ একটিও ছিল না।
সেই একই মাঠ, ১০ বছরের ব্যবধানে অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে লারার দুটি বিশ্বরেকর্ড ‘বিনোদন’। মাঠে থেকেই দুজন ছিলেন লারার দুটি অমর কীতির স্বাক্ষী। দুই ম্যাচেই আম্পায়ার ছিলেন ড্যারেল হেয়ার, দুবারই প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড দলে গ্রাহাম থর্প!
৩৭৫ রানের ইনিংসটির চেয়ে গুণে-মানে একটু পিছিয়েই থাকবে ৪০০ রানের ইনিংসটি। থর্পই পরে বলেছিলেন, ‘৩৭৫ রানের ইনিংসে শুরু থেকে এক বারের জন্যও মনে হয়নি লারা আউট হবে। ৪০০ রানের ইনিংসে বেশ কবারই নড়বড়ে মনে হয়েছে।’
৩৭৫ রানের ইনিংসটার অনেক পরে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক মাইক আথারটন বলেছিলেন, লারার মাত্র ৬০ রানের সময়ই নাকি ফিল টাফনেল আথারটনকে গিয়ে বলেছিলেন, যেভাবে খেলছে লারা, তাতে সোবার্সের ৩৬৫ রানের রেকর্ড না ভেঙে দেয়! গল্পের মত শোনালেও সত্যি!
৪০০ রানের ইনিংসটার সময় পিচ ছিল তক্তা। সিরিজের উত্তেজনা শেষ। পেটের পীড়ায় তৃতীয় দিনে বোলিং করতে পারেননি ম্যাথু হগার্ড। বার বার ফলো থ্রুতে পিচে পা দেওয়ায় শেষ দিকে বোলিং করতে পারেননি হার্মিসন।
তারপরও ইনিংসটির মাহাত্ম কমছে সামান্যই। লারার ওপর তো ছিল এভারেস্টসম চাপ! সেই চাপ নিয়েই আড়াই দিন ব্যাটিং, মনোযোগ ধরে রাখা। ম্যাচের পরে থর্পকে লারা বলেছিলেন, উইকেটে থাকার সময়টায় ওই দুই রাতে ২ ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারেন নি। তবু ১৩ ঘন্টা উইকেটে কাটিয়ে ছিলেন অপরাজিত!
তার পরও এটি লারার সেরা ইনিংস নয়। সেরা নয় ৩৭৫ রানের ওই ইনিংসটিও। এমন অতিমানবীয় দুটি ইনিংসও সেরা নয়, সেটি কেবল লারা বলেই সম্ভব। তাঁর আছে ব্রিজটাউনের ১৫৩*, তার আছে সিডনির ২৭৭, আছে জ্যামাইকায় ২১৩। আরও কত কত! এজন্যই তিনি আমাদের সময়ের সেরা!
– ফেসবুক থেকে