২০ জুন, ১৯৯৬। বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসের এক সোনায় লেখা দিন। সর্বকালের সেরা বাঙালি ক্রিকেটার সেদিন লর্ডসের মাটিতে তাঁর বর্ণময় টেস্ট ক্যারিয়ারের সূচনা করলেন। ২০ জুন, ১৯৯৬ ক্রিকেটীয় ইতিহাসের আরেকটি বিশেষ দিন। বিশ্বের সর্বকালের সেরা এবং জনপ্রিয় আম্পায়ার হ্যারল্ড ‘ডিকি’ বার্ড ২৩ বছরের বর্ণময় ক্যারিয়ারের শেষে, শেষ বারের মত একটি টেস্টের আম্পায়ারিং-এর দায়িত্ব নিয়ে মাঠে প্রবেশ করলেন।
উইজডেন বলছে, প্রথম দিনই যে ধরণের অভ্যর্থনা তিনি পেয়েছিলেন তা হলিউড তারকাদের জন্য তোলা থাকে। ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে নামার সময় সমগ্র লর্ডস ময়দান সম্মানে উঠে দাঁড়াল। দু’দলের ক্রিকেটাররা গার্ড অফ অনার দিলেন সদাহাস্যময় প্রিয় মানুষটিকে। পরে জানা যায় যে মাইকেল অ্যাথারটন, ইংল্যণ্ডের অধিনায়ক, এই সমগ্র চিত্রনাট্যটি লিখেছিলেন এবং গার্ড অফ অনারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতীয় দল খুশি হয়েই সম্মতি দিয়েছিল।
কিন্তু আদ্যন্ত পেশাদার সেই মানুষটির কাছে খেলার মাঠে মাইকেল অ্যাথারটনের জন্য আলাদা করে বিশেষ সম্মান তোলা ছিল না। প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই জাভাগল শ্রীনাথের বিশাল বড় ইনস্যুইং উইকেটের সামনে পেয়ে যায় অ্যাথারটনের বাঁ পা।
আঙুল তুলতে কসুর করেননি ডিকি। যাঁর সম্পর্কে বলা হয় যে একদম ১০০% নিশ্চিত না হয়ে এলবিডব্লিউ দিতেন না। প্যাভিলিয়নে ফিরে যাবার সময় সামান্য থেমে জিজ্ঞাসা করলেন আর্থারটন, ‘এই যে এত সম্মান টম্মানের ব্যবস্থা করলাম, তার এই প্রতিদান দিলেন?’ অ্যাথারটনের গলায় ঠাট্টা ছিল, খুনসুটি ছিল। কিন্তু ডিকি সিরিয়াসলি উত্তর দিলেন, ‘ইট ওয়াস প্লাম্ব মাইকি, গো অ্যান্ড ওয়াচ দ্য রিপ্লে অন টেলিভিশন!’
বস্তুত, খেলে দেখতে যখন শুরু করেছি তখন থেকেই একাধিক লোকগাথা চলে আসছে ডিকি বার্ডের নামে। ৭৪এর ওল্ড ট্রাফোর্ড, সানি গাভাসকারের তখন বড় বাবরি চুল, এক দিক থেকে চোখের ওপর বারবার চলে আসছিল। বার্ডকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন সানি, ‘কাঁচি আছে?’। স্মার্ট উত্তর, ‘নেই, তবে ব্লেড আছে, দাঁড়াও চুপটি করে!’ তারপর চোখের উপর পরা চুলের সামান্য গোছাটি ধরে ব্লেড চালিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে দিলেন ডিকি।
ডিকি বার্ড ক্রিকেট ক্য়ারিয়ার শুরু করেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসাবে ইয়র্কশায়ারের হয়ে ১৯৫৬তে। ইংল্যণ্ডের অন্যতম সেরা ব্যাট জিওফ বয়কট বলেন যে, ডিকি ভাল ব্যাট ছিলেন। কিন্তু বড়ই নার্ভাস। ফলে প্রথমে ইয়র্কশায়ার এবং পরে লেস্টারশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্য়ারিয়ার দীর্ঘায়িত হয়নি। সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১৯৬০ এ লেস্টারের হয়ে সেঞ্চুরি করার পরেও। এই নার্ভাসনেস নাকি আম্পায়ারিং-এর সময়ও ছিল। কিন্তু মাঠে ডিকি একেবারে অন্য জিনিস। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল, মন:সংযোগের পরকাষ্ঠা।
প্রথম টেস্ট, আম্পায়ার হিসাবে ১৯৭৩ অভিষেকে নিউজিল্যান্ডের ব্রুস টেলরের বলে এলবিডব্লিউ দিলেন ইংল্যণ্ড অধিনায়ক রে ইলিংওয়র্থকে। ব্রুস রাউন্ড দ্য উইকেট বল করছিলেন। বার্ডের সহআম্পায়ার চার্লি এলিয়ট বলছেন, আমার কাছে অবাস্তব লেগেছিল, রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে বল কী করে উইকেটে লাগবে’!
ইলিংওয়র্থও প্রশ্ন করেছিলেন ফিরে যেতে যেতে। অবিচল বার্ড মিষ্টি করে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, সিদ্ধান্ত যা নেওয়া হয়েছে তা সঠিক এবং আলোচনাযোগ্য নয়। এলিয়ট বলছেন, টিভি রিপ্লে দেখে সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন, বল অফস্টাম্পে পড়ে অফ কাট করে সোজা হয়েছিল। প্রথম টেস্টেই এতটা দ্বিধাহীন আম্পায়ারিং দেখে এলিয়টের মনেই হয়েছিল যে বার্ড বড় কিছুর জন্য তৈরি।
বড় কিছুই বটে। প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপের প্রথম তিনটি ফাইনালে আম্পায়ারিং করার এক অনন্য রেকর্ড করলেন। ৮৭র ফাইনালে ইংল্যণ্ড যদি না খেলত তাহলে হয়তো চারটি ফাইনালে আম্পায়ারিং করাও হয়ে যেত।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, ইংল্যণ্ডে এক ডিকি বার্ড আছেন, আম্পায়ারিং সুপারস্টার। ইংল্যান্ডেরিই ফ্র্যাঙ্ক চেস্টার ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের সেরা আম্পায়ার। ১৯১৭এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মর্টার ফেটে তাঁর ডান হাত কনুই থেকে উড়ে গিয়েছিল। তবু কালো টুপি পরা চেস্টার কাঠের হাত নিয়ে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। কিংবদন্তি হয় তাঁর কালো টুপি।
সেই ছেলেবেলাতেই দেখেছিলাম রে লিন্ডওয়াল বল করছেন আর দু পা ফাঁক করে হাঁটুতে হাত রেখে নিচু হয়ে শ্যেন দৃষ্টিতে ব্যাটসম্যানের দিকে তাকিয়ে ফ্র্যাঙ্ক। ডান হাতটা সাদাকালো ছবিতে কালো লাগত, কাঠের ছিল। ডিকির তেমন ছিল তাঁর ক্যাপ, সাদা গলফ ক্যাপ, সামনের দিকে বোতাম আটকানো, বিখ্যাত করে যান তিনি।
স্পষ্টবাদিতা এবং নির্ভুল সিদ্ধান্তের জন্য বিখ্যাত ছিলেন ডিকি। এলবিডব্লিউর ক্ষেত্রে তো আগেই বলা হয়েছে যে নিশ্চিত না হয়ে কখনও দেননি। তাই ভুল হবার সম্ভাবনাও কম। তিনটে মজার ঘটনা দিয়ে স্পষ্টবাদিতা এবং ভয়ডরহীন আম্পায়ারিং-এর বর্ণনা দিই।
অ্যালান ল্যাম্ব ব্যাট করতে এলেন পকেটে ওয়াকিটকি। স্বভাবতই বার্ড আপত্তি তুললেন এবং ল্যাম্বকে বাধ্য করলেন যে ওয়াকি টকি ডিকির কাছে জমা রাখতে। তৃতীয় ওভারেই বেজে উঠল সেটি। ওয়াকিটকির ওপার থেকে ইয়ান ‘বিফি’ বোথাম, ‘ল্যাম্বিকে বল চালিয়ে খেলতে, না হলে আউট হয়ে যেতে বলো!’ কিছু না বলে ল্যাম্বের কাছ থেকে শিখে নিয়ে ওয়াকিটকি বন্ধ করে রাখলেন পকেটে।
আরেকবার ম্যালকম মার্শাল তখন ভয়ঙ্কর ফর্মে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের বিশাল লম্বা চওড়া চেহারায় পারতপক্ষে কেউ কিছু বলত না। অবশ্য তারা অস্ট্রেলীয়দের মত স্লেজও করত না। কিন্তু তা বলে কি ভয় হত না? বাউন্সারের পর বাউন্সার করতে শুরু করলেন ম্যালকম, টেল এন্ডারদের। ডিকি থাকতে না পেরে মিড অফে খেলা বলটিকে দেখিয়ে মার্শালকে বললেন, ‘বলটা তুলে এনে এখানে অপেক্ষা কর। আমি ততক্ষণে তোমার এই মাত্রাতিরিক্ত শর্ট বলের বিষয়ে তোমার অধিনায়ককে সতর্ক করে আসি যে আর বেশি করলে তোমাকে এই ইনিংসের জন্য বোলিং করা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব’।
কাউন্টি খেলাতেও এই কম্পোজার ধরে রাখতেন। একবার সমারসেট ইচ্ছে করে ওভাররেট স্লো করার জন্য বোলারকে দিয়ে দু হাত লম্বা ‘নো’ বল করাল। জবাবে পরবর্তী পাঁচটি বল নো বল ডেকে বার্ড এগিয়ে গেলেন বোলারের দিকে, এটা বুঝিয়ে দিতে যে মাঠের মধ্যে বস কে! তাঁর পরিচালনায় কোনও ছিঁচকে-মি চলবে না!
বার্ড পরবর্তী অধ্যায়ে ‘মাঙ্কিগেট’ কেলেঙ্কারির সময় বলেছিলেন, ‘স্টিভ (বাকনর) আর মার্ক (বেনসন)এর উচিত ছিল যে, দুই অধিনায়ককে কাছে ডেকে, ঠাট্টা করে কিন্তু স্পষ্ট করে বোঝানো যে হাজার হাজার লোক টিভিতে গ্যালারিতে বসে পয়সা খরচ করে সময় নষ্ট করে দেখছে। তাদের সামনে সঠিক দৃষ্টান্ত রাখতে হবে। অতএব বাড়াবাড়ি একদম নয়’। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এতেই কাজ হত। নিজের ক্ষেত্রেও হয়েছে বারবার।
প্রযুক্তি নিয়ে নাক সিটকানোও ছিল বার্ডের। বর্তমান সময়ের সেরা আম্পায়ারের নাম বাছতে গিয়ে বলেন, এখন তো আম্পায়ারিং-এর মানবিক সত্ত্বাই নেই আর। প্রযুক্তি দিয়ে আম্পায়ারদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভুলও বেশি বেশি হচ্ছে।
শেষ করার আগে আর দুটো গল্প, শেষ লর্ডস টেস্টের। সৌরভ গাঙ্গুলি ব্যাট করছেন। মসৃণ গতিতে এগোচ্ছেন অভিষেকের সেঞ্চুরির দিকে। ৭০ হয়ে গেছে রান, এমন সময় বাঁ-হাতি অ্যালান মুলালির বল অফস্টাম্পের বাইরে থেকে কিক করে উঠল, সামলাতে গিয়ে সৌরভ বাঁ-হাত হ্যান্ডেল থেকে সরিয়ে দিলেন।
তবুও শেষ রক্ষা হল না যেন, বল বেলুনের মত উঠে দ্বিতীয় স্লিপে গ্রেম হিকের তালুবন্দী। ইংল্যণ্ড খেলেয়াড়রা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু বার্ড নড়লেন না। টিভি রিপ্লে দেখালও, বল সৌরভের বাঁ-কাঁধে লেগে গেছে। ব্যাটের খুব কাছ দিয়ে গেলেও লাগেনি। শেষ টেস্টেও আম্পায়ারিং গুণমানের নড়চড় হয়নি।
আর শেষ তথ্য? টেস্টে ডিকি বার্ডের শেষ আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত প্রথম ইনিংসের শতরানকারী উইকেটরক্ষক জ্যাক রাসেলকে এলবিডব্লিউ, কখনও নিশ্চিত না হয়ে যা দেননি। বোলার? সৌরভ গাঙ্গুলি। এবারেও বিতর্কের অবকাশ রাখেননি। উইজডেন পত্রিকা তাঁকে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট আম্পায়ার বলেছে।
সঙ্গে খেলা অথবা আম্পায়ারিং-এ খেলা প্রতিটি খেলোয়াড়ের মুখে ডিকি বার্ডের প্রশংসা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। নার্ভাস মানুষটা যে কী করে তিন কাঠির পেছনে দাঁড়িয়ে নির্ভিক, অবিচল হয়ে যেতেন তা কোনও কোচিং বা আম্পায়ারিং ম্যানুয়ালে লেখা থাকেনি। থাকে না। আম্পায়ারিং ছেড়েছেন প্রায় ২৪ বছর হয়ে গেল, তবু যখনই ক্রিকেট আম্পায়ারিং-এর কথা আসে তখন বাকনার, বেঙ্কট, শেপার্ড, টঊফেল, বাউডেনদের আগে চলে আসে, সাদা ক্যাপ পরিহিত, হাতা গোটানো সদা হাস্যময় মুখটির কথা। ছোট্ট পাখিটি (ডিকি বার্ডের মানে)-র গান যতদিন ক্রিকেট চলবে ততদিন শেষ হবে না।