চাইনিজ সুপার লিগ পথ, স্বপ্ন দেখিয়ে অন্ধকারে বিলীন

দেশের ফুটবল ঢেলে সাজাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে সৌদি আরব। পর্তুগিজ মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে দিন বদলের হাওয়া লেগেছে দেশটির ফুটবল অঙ্গনে। ইউরোপের সাথে তাল মিলিয়ে এরই মধ্যে বহু তারকা ফুটবলারকে সৌদি আরবমুখী করেছে তাঁরা।

এর মধ্যে রয়েছেন করিম বেনজেমা, এনগালো কান্তে, রবার্তো ফিরমিনো, এদুয়ার্দো মেন্দি, মার্সেলো ব্রোজোভিচ, কালিদু কুলিবালি, রুবেন নেভেসদের মতো তারকা ফুটবলাররা। এক বছরের ব্যবধানে সৌদি প্রো লিগের ঔজ্জ্বল্য আর জনপ্রিয়তা যে বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে তা আর এখন বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবে এই যে দলগুলোর কাড়ি কাড়ি অর্থ বিনিয়োগ, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদে কি সৌদি আরবের ফুটবল সফল হবে? উয়েফা সভাপতি আলেক্সান্দার সেফেরিন অবশ্য বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবের ফুটবলের জন্য এটি বড় একটি ভুল পদক্ষেপ। কারণ তারা যেটা করছে তা ঠিক হচ্ছে না। তাদের উচিত নিজেদের একাডেমিগুলোর ওপর জোর দেওয়া।’

উয়েফা সভাপতি অবশ্য অতীত এক ঘটনা থেকেই এ বিবৃতি দিয়েছিলেন। কারণ সৌদি আরবের আগেও কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করেছিল চীন। কিন্তু শুধু অর্থ খরচ শেষ পর্যন্ত চাইনিজ সুপার লিগের সে প্রজেক্টে সফলতা আনতে পারেনি। উল্টো গত ৩ বছর ধরে ভগ্নদশায় রয়েছে এ লিগটি।

একটু পিছনে ফেরা যাক। সময়টা ২০১৪ বিশ্বকাপের পর। ব্রাজিলের অস্কার, হাল্ক, পাউলিনহো তখন ইউরোপ মাতাচ্ছেন। একই সাথে দিদিয়ের দ্রগমা তখন ক্যারিয়ার সায়াহ্নে। ঠিক এমন সময়েই তাদের উপরে চোখ রাখল চাইনিজ সুপার লিগ কর্তৃপক্ষ। ইউরোপের চেয়ে বহুগুণ পারিশ্রমিক অগ্রাহ্য করতে পারলো না অস্কার, হাল্করাও। ইউরোপ ছেড়ে তাঁরা পাড়ি জমালেন চীনে।

এর কিছু বছর পর তাদের সাথে যোগ দিলেন দুই আর্জেন্টাইন কার্লোস তেভেজ আর লাভেজ্জি। লাভেজ্জিকে তো হেবেই চীন এফসি দলে ভেড়ালো সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকে। এমন তারকার ফুটবলারদের উপস্থিতিতে চাইনিজ সুপার লিগ মুহূর্তের মধ্যেই সবার আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠল।

কিন্তু সেই জৌলুশ বেশিদিন টিকল না। ২০১৯ এর শেষ দিকে করোনার কারণে চীনে দেখা দিল চরম আর্থিক মন্দা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকায় আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে গেল পুরো লিগ। টানা দুই বছরের করোনার ঢেউয়ে ততদিনে চাইনিজ সুপার লিগ ডুবোডুবো ভাব।

এরপর সেখান থেকে আর উতরে উঠতে পারেনি লিগটি। সিএসএলের অন্যতম দল জিয়াংসু এফসির মালিক করোনার পর ক্লাব বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। ৮ বারের লিগ চ্যাম্পিয়ন গুয়াংজু এফসির বর্তমান অবস্থা আরো শোচনীয়। গত মৌসুমের সিএসএলে তাঁরা পৌঁছে যায় ব্যর্থতার তলানিতে। তাদের জায়গা এখন রেলিগেশন পর্বে।

এখানেই শেষ নয়। ২০১৬-১৭ মৌসুমেই এক হেবেই চায়না এফসি খেলোয়াড়দের পিছনে খরচ করেছিল ৪০০ মিলিয়ন ইউরো। এর মধ্যে লাভেজ্জিকেই তাদের সপ্তাহ প্রতি দিতে হতো ৭ লক্ষ ৯৮ হাজার ইউরো। ফলত, ফুটবলারদের পিছনে চড়া পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে ক্লাবের অবকাঠামোগত উন্নয়নই নিশ্চিত করতে পারেনি ক্লাবটি।

তবে চাইনিজ সুপার লিগের এমন তলানিতে যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় দায়টা ছিল চাইনিজ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (সিএফএ)। কারণ তাদের এক সিদ্ধান্তের গ্যাঁড়াকলেই ক্লাবগুলোকে পরবর্তীতে বড় রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

২০১৮ সালে সিএফএ বিদেশি ফুটবলার ভেড়াতে নতুন এক নিয়ম জারি করে। যেখানে বলা হয়, কোনো ফুটবলারকে যদি ৫ মিলিয়ন ইউরোর বেশি পারিশ্রমিকে আনা হয়, তাহলে ক্লাবগুলোকে ঐ একই পরিমাণ অর্থ দিতে হবে সিএফএ-কে।

আর এ নিয়মের কারণেই আস্তে আস্তে ক্লাবগুলো বিদেশি ফুটবলার কেনা কমিয়ে দেয়। তারকা সব ফুটবলাররাও চাইনিজ সুপার লিগ ছাড়তে শুরু করেন। ক্রমেই জৌলুশ হারাতে থাকে সিএসএল।

এর মধ্যে আবার আর্থিক অনিয়ম আর বহু দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হন চাইনিজ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি শেন জুয়ান। মূলত সময়ের সাথে এমন বহু অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে পিছিয়ে পড়ে চায়নার ফুটবল। যদিও এর পিছনে বড় একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে কোভিড ১৯। তবে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের কারণেই আজ চায়নার ফুটবলের এ বেহাল দশা।

এই মুহূর্তে একটা ফুটবল বিপ্লবের পথে রয়েছে এশিয়ার আরেকটি দেশ সৌদি আরব। যদিও এ যাত্রায় আছে সৌদি সরকারও। তারপরও চাইনিজ ফুটবলের এভাবে অবনমন হওয়ার ঘটনা তাদের একটা সতর্কতামূলক শিক্ষা হিসেবেই কাজে দিতে পারে। সৌদি আরব প্রো লিগ এক সময় নক্ষত্ররাজিতে পূর্ণ থাকবে নাকি আরেকটি চায়না সুপার লিগের মতো হবে, তা অবশ্য সময়ই বলে দিবে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link