২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে শেন ওয়াটসনের সাথে ওয়াহাব রিয়াজের সেই দ্বৈরথ, সেই লড়াইটা যেন ভোলার নয়। অবশ্য ঘটনার সূত্রপাতটা ঘটান অজি পেসার মিশেল স্টার্ক।
প্রথম ইনিংসে ওয়াহাব রিয়াজ তখন ব্যাট করছিলেন। স্টার্কের বাউন্স আর গতি সামলাতে ওয়াহাব যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, স্টার্ক তখন মুচকি হেসে ব্যাঙ্গ করছিলেন ওয়াহাবকে। ২২ বলে ১৬ রান করে সেই স্টার্কের বলেই আউট হন ওয়াহাব। একটা চাপা ক্ষোভ অবশ্য মনে মনে পুষে রেখেছিলেন ওয়াহাব। স্টার্কের প্রতি জন্মানো সেই ক্ষোভটা পরবর্তীতে বল হাতে ঝাড়েন শেন ওয়াটসনের উপর!
২১৪ রানের সহজ টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে দলীয় ১১তম ওভারেই ৫৯ রানে ৩ উইকেট হারায় অজিরা। তখন ক্রিজে আসেন শেন ওয়াটসন। আর তখনই শুরু প্রতিশোধের লড়াই। স্টার্ককে পাননি, তবে ক্ষোভের আগুনে পানিও ফেলতে দেননি ওয়াহাব। ওয়াটসনকে পেয়ে সেই ক্ষোভের আগুন যেন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল।
প্রথম বল থেকেই ওয়াটসনকে গতি আর বাউন্সে পরাস্থ করতে থাকেন ওয়াহাব। ১৫০ গতিতে বল ছুঁড়ে ওয়াটসনকে নাজেহাল করছিলেন। ওয়াহাবের গতি আর ভয়ংকর বাউন্সে ওয়াটসনও ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলেন না ক্রিজে। একের পর এক গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছিলেন এই পাকিস্তানি পেসার।
ওয়াটসনের তখন ১৫ বলে সংগ্রহ মাত্র ৪ রান! ইনিংসের ১৭তম ওভারের প্রথম বলেই ওয়াহাব রিয়াজের বাউন্সার সামলাতে না পেরে ফাইন লেগে ক্যাচ তুলে দেন ওয়াটসন। কিন্তু বিধিবাম! একদম সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়ে যেন বিশ্বকাপটাই ফেলে দেন রাহাত আলি!
ওয়াহাব রিয়াজের গতি আর বাউন্স সামাল দিয়েও পরবর্তীতে ৬৬ বলে ৬৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন ওয়াটসন। সেই সাথে অজিরাও নিশ্চিত করে সেমিফাইনালের টিকেট। স্টার্কের ক্ষোভটা সেদিন ওয়াটসনের উপর পুরোপুরিই মিটিয়েছিলেন এই পাকিস্তানি পেসার।
জনপ্রিয় অনলাইন ক্রিকেটের সংবাদ মাধ্যমে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর এক বিশ্লেষক সেই লড়াইকে টুর্নামেন্টের সেরা লড়াই হিসেবে মত দেন। ওয়াহাবের সেই ভয়ংকর স্পেল হয়তো শেন ওয়াটসনও কোনোদিন ভুলবেন না। ওয়াহাব নিজেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা স্পেল ছিল এটা।’
অবশ্য মাইকেল ক্লার্কও সেদিন ওয়াহাবের সেই আগ্রাসী পেসের শিকার হয়েছিলেন। সেদিনের ম্যাচ শেষে ক্লার্ক বলেছিলেন, ‘আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে আজকের ম্যাচের পরেও আমি বেঁচে আছি।’ তিনি আরো দাবী করেন এর চেয়ে ভয়ংকর বোলিংয়ের মুখোমুখি তিনি আর কখনোই হননি। শুধু ক্লার্কই নন, ইংলিশ ব্যাটসম্যান কেভিন পিটাসেন, ব্রায়ান লারা থেকে শুরু করে অনেক সাবেক ক্রিকেটারই ওয়াহাবের সেই স্পেলকে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পেল হিসেবে আখ্যা দেন।
পেস বোলার তৈরিতে পাকিস্তান বরাবরই বেশ জনপ্রিয়। শোয়েব আখতার, ওয়াসিম আকরাম উমর গুল, ওয়াকার ইউনুস, মোহাম্মদ আসিফ, মোহাম্মদ আমিরের মতো বোলাররা বিশ্ব ক্রিকেটে শাসন করেছেন অনেকদিন। এদের ছাড়াও পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে উঠে এসেছিলেন আরেক সম্ভাবনাময় তারকা পেসার। যার দুর্দান্ত গতির কারণে ধরা হতো – তিনি হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটে সেরাদের একজন হবেন; পাকিস্তান ক্রিকেটকে একটা সময় অনেক উপরে নিয়ে যাবেন। কিন্তু নিজের প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের কোনোটির সঠিক ব্যবহার তিনি পুরোপুরি করতে পারেননি।
২৮ জুন ১৯৮৫।
পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াহাব রিয়াজ। গলি ক্রিকেটে টেপ টেনিস বলে গতির ঝড় তোলা ওয়াহাব রিয়াজের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দল। পরবর্তীতে গতির ঝড় তুলে জায়গাও করে নিলেন জাতীয় দলে।
২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ – জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদাপর্ণ এই পেসারের। এরপর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে ডাক পান তিনি। সেই সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক হয় ওয়াহাবের।
অভিষেক ম্যাচেই ২২ রানে ৩ উইকেট শিকার করেন। সাথে নিজের গতি আর বাউন্সে মুগ্ধ করেন দর্শক সহ ক্রিকেট বিশ্লেষকদের। এরপর ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজে ডাক পান তিনি। নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই পাঁচ উইকেট শিকার করে সবার নজর কেঁড়েছিলেন ওয়াহাব। নবম পাকিস্তানি বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে পাঁচ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েন এই পেসার।
শোয়েব আখতার, মোহাম্মদ সামির পর ওয়াহাবকেই পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে গতিময় বোলার হিসেবে জানা হয়। গড়ে ১৪৫ কি.মি স্পিডে বল ছোঁড়েন ওয়াহাব। ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ১৫৪ কি.মি গতিতে বল করেছেন তিনি।
ওয়াহাব রিয়াজের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। সেখানে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে শোয়েব আখতারের মতো তারকা বোলারকে বাদ দিয়ে সুযোগ দেওয়া হয় ওয়াহাবকে। আর সেই সুযোগকে ভালোভাবেই কাজে লাগান এই পেসার। সেমিফাইনালে ভারতের কাছে হারলেও ওয়াহাব শিকার করেন ওয়ানডেতে মেইডেন পাঁচ উইকেট। ভারতের ব্যাটসম্যানদের সেদিন বেশ ভুগিয়েছিলেন এই তরুণ পেসার।
দ্রুত গতিতে বল করতে পারার জন্য বেশ সুনামও কামিয়েছিলেন ওয়াহাব। তবে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বেধরক মারও খাওয়ার বেশ রেকর্ড আছে তাঁর। ওয়ানডে ইতিহাসে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়া দ্বিতীয় বোলার তিনি।
২০১৬ সালে ন্যটিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ ওভারে ১১০ রান দিয়ে এই লজ্জার রেকর্ডে নাম লেখান তিনি। সেদিন ইংলিশরা প্রথমে ব্যাট করে ৪৪৪ রানের পাহাড়সম স্কোর দাঁড় করায়। এর আগে আরেকবার ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০ ওভারে ৯৩ রান দেন তিনি।
ক্যারিয়ারে খুব বেশি সফলতার ছোঁয়া পাননি বর্ষীয়ান এই পেসার। বল হাতে চেহারায় যে আগ্রাসন তিনি দেখাতেন, পারফরম্যান্সে সেটা ছিল অনেকটাই ফিকে। ইনজুরি আর বাজে পারফরম্যান্সে বাদ পড়লেও সব সময়ই বিশ্ব আসরে নির্বাচকরা অভিজ্ঞতা আর গতির বিচারে দলে রাখতেন ওয়াহাবকে। তবে, সেই ভরসার প্রতিদান তিনি দিতে পেরেছেন সামান্যই।
যদিও বিশ্বকাপ ইতিহাসে তিনি পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। বিশ্বকাপের মঞ্চে তিনি পাকিস্তানের জার্সি গায়ে বরাবরই বেশ ভাল করেছেন। ভয়ংকর পেস আর বাউন্সারের জন্য ওয়াহাব রিয়াজকে অনেক সাবেক ক্রিকেটারই ভবিষ্যত সেরাদের একজন মনে করতেন।
কিন্তু নিজের প্রতিভার মোটেও সুবিচার করতে পারেননি এই পেসার। ক্যারিয়ারের একদম শেষ দিকেই আছেন তিনি। ক্যারিয়ারে অর্জন বলতে বিশেষ কিছুই নেই। প্রাপ্তির খাতা অনেকটাই ফাঁকা। নিজের প্রতিভার প্রতি ধ্যান-জ্ঞ্যান আর তপস্যাটা রাখতে পারলে হয়তো অসাধারণ কিছু হতেন। তবে, হয়তো সাধারণ হিসেবেই ক্যারিয়ার শেষ করবেন তিনি।