Social Media

Light
Dark

প্রতিভার আকাশে এক নক্ষত্রপতনের গল্প

‘আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে আজকের ম্যাচের পরেও আমি বেঁচে আছি’ — কথাটা বলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার তখনকার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক।

মূল ঘটনায় ফেরা যাক। ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের দৃশ্যপট। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২১৩ রানে অলআউট হয় পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়ার কাছে এ আর কী এমন লক্ষ্য। নিতান্তই দুধভাত ব্যাপার! অ্যাডিলেডের গ্যালারি তাই তখন একপেশে এক ম্যাচেরই স্বাক্ষী হওয়ার পথে। ধারাভাষ্যকক্ষেও নেই উত্তেজনার সুর।

কিন্তু এমনই এক ম্যাচের সম্ভাব্য ফলটা পাল্টে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ লড়াই করলেন এক পেসার। প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা তখন যেন আর অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তানের মধ্যে নেই। খেলাটা হচ্ছিল এক বাঁহাতি পেসার আর গোটা অস্ট্রেলিয়ার দলের মধ্যে। অন্য প্রান্ত দিয়ে যেখানে গড়পড়তা বোলিং হচ্ছিল, সেখানে এই বাঁহাতি ফাস্ট বোলার একাই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে।

৬ ওভারের প্রথম যে স্পেলটি করলেন, তাতে রীতিমত চক্ষু ছানাবড়া ওয়ার্নার ক্লার্কদের। গতির আগ্রাসনে রীতিমত আতঙ্কের ভয়াবহতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাকি ব্যাটারদের। ক্রিকেটে অল্পবিস্তর খোঁজ রাখলেও বোধহয় নামটা অনুমানযোগ্য। হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন, নামটা ওয়াহাব রিয়াজ।

ওয়াহাব রিয়াজ সেদিন পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে জেতাতে পারেননি। তবে সেদিন ওয়াটসনকে একের পর এক বাউন্সারে ওয়াহাবের অসহায় করে রাখা ঐ বিধ্বংসী স্পেলটাই অনেকের কাছে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা স্পেল হিসেবে বিবেচিত হয়। যা নিজেও পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন স্বয়ং শেন ওয়াটসন। আর ম্যাচের সময়ই তো, শেন ওয়ার্ন বলে উঠেছিলেন, ‘কী বোলিংই না করল ছেলেটা! আমার দেখা সেরা বোলিংয়ে অবশ্যই এটিও থাকবে।’

পাকিস্তান সেদিন রাহাত আলীর ক্যাচ মিসের আক্ষেপে পুড়েছিল। ওয়াহাব রিয়াজ ও হয়তো গোটা ক্যারিয়ারে এমন একটা আক্ষেপের গল্পে আটকে থাকবেন। কারণ পেসার তৈরির তীর্থভূমি পাকিস্তানের লাহোর থেকে উঠে আসা এ পেসার নিজের প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের কোনোটিরই সঠিক ব্যবহার করতে পারেননি।

দারুণ প্রতিভা থাকা স্বত্ত্বেও তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আটকে গিয়েছে ২৩৭ টি উইকেটে। ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পাকিস্তানের হয়ে খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৫৪ টি ম্যাচ। যার শেষটি আবার হয়েছে সেই ৩ বছর আগে, ২০২০ সালে।

গলি ক্রিকেটে টেপ টেনিস বলে শুরু। এরপর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে পাকিস্তানের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ। শুরুটাও হলো দুর্দান্ত। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকে ৮  ওভারে ১৯ রানের বিনিময়ে নিলেন ২ টি উইকেট।

টেস্ট অভিষেক ছাপিয়ে গেল আগেরটাকেও। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজে ডাক পান তিনি। নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে বল হাতে নিয়েই পাঁচ উইকেট নেন তিনি। আর এরই সাথে,  নবম পাকিস্তানি বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে পাঁচ উইকেট শিকারের কীর্তিতে নাম লিখিয়ে ফেলেন ওয়াহাব রিয়াজ।

তবে ওয়াহাব রিয়াজ সবার নজরে আসেন ২০১১ বিশ্বকাপে। ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচে শোয়েব আখতারের জায়গায় সুযোগ পেয়ে যান তিনি। আর সুযোগ পেয়েই নিজের জাত চেনাতে ভুল করেননি ওয়াহাব। গুণে গুণে ৫ উইকেট শিকার করেন এ পেসার। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ওয়াহাব রিয়াজের ফাইফার পাওয়ার দিনে শেষ পর্যন্ত হেরে যায় পাকিস্তান।

ওয়াহাব রিয়াজের ক্যারিয়ার হাইলাইটস বলতে গেলে এতটুকুই। যতটা সামর্থ্য ছিল, তার পুরোটা তিনি পাকিস্তানকে দিতে পারেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩ বার ৫ উইকেট পেয়েছেন। যার মধ্যে ২ বারই পাকিস্তান হেরেছে। লম্বা সময়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বহুবার আসা যাওয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। এ কারণে মাত্র ২৭ টেস্ট, ৯১ ওয়ানডে আর ৩৬ টা টেস্টেই থেমে গিয়েছে ওয়াহাব রিয়াজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।

আগ্রাসী এ পেসারের এত বছরে ক্যারিয়ারে বোলিং আগ্রাসনের পাশাপাশি সঙ্গী হয়ে আছে বিব্রতকর কিছু রেকর্ডও। ওয়ানডে ইতিহাসে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়া দ্বিতীয় বোলার তিনি। ২০১৬ সালে ন্যটিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ ওভারে ১১০ রান দিয়ে বিব্রতকর এই রেকর্ডে নাম লেখান তিনি। এ ছাড়া, ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি ম্যাচে ১০ ওভারে ৯৩ রান দিয়েছিলেন তিনি।

ওয়াহাব রিয়াজ পাকিস্তানের ইতিহাসে সফল কোনো পেসার নন। কারণ সফলটার ধারাবাহিক ছোঁয়াটাই কখনো তিনি পাননি। বরং তাঁকে নিয়ে যা প্রত্যাশা ছিল, তা তাঁর কাছ থেকে দেখতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে অনেকে। অর্জনশূন্য ক্যারিয়ার অবশ্যই নয়। তবে, প্রতিভার যে জয়গান তাঁর কাছে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, তার কানাকড়িও প্রদর্শিত হয়নি।

তবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে ওয়াহাব অবশ্যই বিশেষ কিছু। সেটা শুধু ২০১৫ বিশ্বকাপে অজি ব্যাটারদের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার জন্য নয়। ওয়াসিম আকরামের পরে পাকিস্তানের হয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৩৫ টি উইকেট পেয়েছেন এই ওয়াহাব রিয়াজ। পাকিস্তান ক্রিকেটে স্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য শুধু এই পরিসংখ্যানটাই তো যথেষ্ট।

পেসার ওয়াহাব রিয়াজ অবশ্য রাজনীতির মাঠেও বেশ প্রতাপশালী এক নাম। এ বছরের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ওয়াহাব রিয়াজ। অন্তর্বর্তীকালীন সেই দায়িত্ব শেষে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন এ পেসার।

ওয়াহাব রিয়াজের বয়সটা ৩৮ পেরিয়েছে এ বছরেই। পাকিস্তান দল থেকে দূরে ছিলেন প্রায় ৩ বছর। তাই আর কালক্ষেপণ করলেন না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষের ঘোষণাটা দিয়েই দিলেন। তবে এখনই বাইশ গজ ছাড়ছেন না তিনি। খেলবেন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট। কারণ সেখানে তো তিনি এখনও রঙিন।

এই মুহূর্তে শুধু ধূসর হয়ে গিয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্মৃতি। তবে সেই স্মৃতিতেও হয়তো নিজের বোলিং আগ্রাসন, ব্যাটারদের নাকানি চুবানি খাওয়ার দৃশ্যে খুঁজে নিবেন রঙিন এক আভা।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link