নয় উইকেট পড়ে গেছে আর একটা বল বাউন্ডারির দিকে যাচ্ছে আর প্রায় বিয়াল্লিশ একজন ডাইভ দিয়ে বলটা আটকাচ্ছেন। দরকার ছিল না, একটা তিনের জায়গায় চার হলে আলাদা করে খেলার ফলাফলে কিসসু পরিবর্তন হত না। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকাবার ফলে যেটা হবে সেটা হল অতিরিক্ত তিনদিনের গা ব্যথা।
কিন্তু এটাই জিমি, জিমি জেমস মাইকেল অ্যান্ডারসন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ডেল স্টেন তদ্দিনে খেলা ছেড়েছেন, তখন একটা ফিচার পড়েছিলাম, অ্যান্ডারসনের বাবাও নাকি অনেক বয়স পর্যন্ত মাইনর কাউন্টি খেলেছিলেন। জিনগত ব্যাপার।
এখন ক্রিকেটে ফিটনেসের অনেক দাবিদাওয়া বেড়েছে। তবুও মাঝে মধ্যেই দেখি অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে খেলছেন। আমাদের ছেলেবেলায় ক্লাইভ লয়েড, আর তার পর জাভেদ মিয়াঁদাদকে দেখেছিলাম ২০র ম্যাজিক মাইলস্টোনটা পেরিয়েছিলেন।
গাভাস্কার বা ইমরান অনেকটা কাছাকাছি গেছিলেন বটে। তবে বয়কট রেবেল ট্যুরে দক্ষিণ আফ্রিকা না গেলে ব্যাপারটা করে ফেলতেন হয়তো। মহিন্দারও শেষে ড্রপড না হলে।
সচিন অনেক আগে শুরু করে অনায়াসে কুড়ি পেরিয়েছেন। কিন্তু জিমি? জিমি পেস বোলার। ইমরানের মতো অলরাউন্ডারও নন যে শেষে এসে ব্যাটে মন দিয়ে ম্যানেজ করবেন। কিন্তু দুই প্রজন্মকে একইভাবে কাঁদিয়েছেন। সচিনকে ৯ বার বিরাটকে ৭ বার আউট করেছেন কেউ এটা ভাবতেই অবাক লাগে।
বিশ্বের ইতিহাসে বোধহয় সবার থেকে সেরা আউটস্যুইং তাঁর হাতে ছিল, এই কালকে পর্যন্ত (কপিলদেব ও রিচার্ড হেডলির কথা মাথায় রেখেই বলছি)। কিন্তু অ্যান্ডারসন বোধহয় আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন ট্রয় কুলির সঙ্গে কিন্সিওলজি নিয়ে কাজ করার পর। আর ২০০৯এর পর ডেভিড সাকারের হাতে পড়ে অ্যান্ডারসন আর ব্রড দুজনেই বিশ্বমানের হয়ে ওঠেন।
ওয়াবল সিম, অর্থাৎ আউট স্যুইং-এর সময় আপনি বলের সিম প্রথম স্লিপের দিকে রাখলেও তর্জনী ও মধ্যমা রাখবেন সেলাইয়ের লাইনের দুই পাশে। ওয়াবল সিমের ক্ষেত্রে সিমের অভিমুখ প্রথম স্লিপের দিকে থাকলেও হয় তর্জনী বা মধ্যমা থাকবে সেলাইয়ের উপরে।
বল পিচ করার ঠিক আগে লেট স্যুইং করবে, সিমের পাশে পড়লে সিম মুভমেন্ট হবে। অনেকটা ইমরানের ইনডিপারের মতো, সিম মুভমেন্টে বল ভিতরে আসছে কিন্তু ব্যাটের কাছে এসে পালিশ বাইরের দিকে থাকার জন্য অতিরিক্ত এক কবজি আরও ঢুকবে।
কিন্তু অ্যান্ডারসনের তো ইমরানের মতো গতি ছিল না। ব্রডেরও না। কিন্তু এই যে সঠিক জায়গায় বল ফেলে স্যুইং এবং সিমের উপর নিয়ন্ত্রণ এখানেই অ্যান্ডারসন ত্রাস হয়ে ছিলেন। বিশেষত ইংল্যন্ড বা নিউজিল্যান্ডের পরিবেশে।
না তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা নন। তাঁর সমসাময়িক ডেল স্টেন সেই ব্র্যাকেটে ঢুকবেন, কারণ সর্বত্র, বিশেষত উপমহাদেশের পারফরম্যান্সের জন্য। যদিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিমির রেকর্ড বেশ ভালো, তবে সেটা ব্যাটারদের স্কিলের জন্য অনেক বেশি মনে হয়।
কিন্তু, তবুও এত দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটারদের সমীহ আদায় করে নেওয়াটা মুখের কথা নয়। আরও একটি কথা না বললেই নয়। জিমি মূলত আউট স্যুইং বোলার হলেও বোল্ড করার ক্ষেত্রে মাত্র মুরলিথরণের পরেই তাঁর অবস্থান। মুরলি অফস্পিনার বল ভিতরে আসে।
এটার দুটো কারণ হতে পারে, এক লেগ মিড থেকে লেট স্যুইং। তারপরেও ক্রিজের একেবারে ধার থেকে আউটস্যুইং করলে বল ভিতরে আসে, কিন্তু পিচ পড়ার পর সোজা হয়ে বেল উড়িয়ে দেয়। আর এক নাগাড়ে এক জায়গায় বল ফেলে যাবার ক্ষমতা। পরবর্তীকালে বল যখন গতিতে ১২০’র কোটায় ঢুকে গেছে, তখনও ব্যাটাররা সামলে খেলেছেন অ্যান্ডারসনকে। কারণ জানতেন যে সামান্য এদিক ওদিক হলেই পিছনের ফার্নিচার টুপিহারা হবে।
ব্রড বা অ্যান্ডারসনের এতো দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যন্ডের হয়ে খেলাকে যদি তাঁদের ফিটনেসের উজ্জ্বল নিদর্শন বলি, তারপরেও বলতে হবে যে এই সময়ে প্রকৃত ফাস্ট বোলার, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করবে, এমন কেউ উঠে আসেননি। ইসিবির পক্ষে তা একেবারেই ভালো বিজ্ঞাপন নয়।
জেমস অ্যান্ডারসন অবসর নিলেন। দীর্ঘদিন ধরে খেলতে খেলতে একটা সময় এমন আসে চিরন্তন কথাটা লেবেলের মতো সেঁটে যায়। কিন্তু সব চিরন্তনেরও অন্ত থাকে। জিমির কাল হল। যে টি শার্টটায় লেখা ছিল ২২.০৫.২০০৩-১২.০৭.২০২৪।
একুশ বছরে সাবালক হয় পুরুষ, একুশ বছরে পরিণত হয় মনন। একুশ বছরে জিমি অ্যান্ডারসন লাল চেরির বিষ ছড়ান সবুজ গালিচার অন্দরে। একুশ বছরে যুগাবসান হয়। জিমি অ্যান্ডারসন শেষ শিকারের পর গাণ্ডীব তুলে রাখেন। শেষ? নাহ বাঁ হাতে কট অ্যান্ড বোল্ডটা রাখতে পারলে হয়তো শেষ শিকারটা তাঁরই হত।
তবুও ওই বিয়াল্লিশ বছরে ডাইভ দিয়ে বল বাঁচানোটাই জিমির পরিচয় হয়ে থেকে গেলো। মনিপুরী নৃত্যের মতো মাদল নিয়ে ছোট্ট একটা লাফ এবং তারপর ঠিক কানের পাশ দিয়ে গোলা ছোঁড়া। ক্লাসিকাল পৃথিবীটা কালকে বদলে গেল। দুই যুগ পর জিমি অ্যান্ডারসন বিদায় নিলেন! অ্যাডিউ জেমস!