তখন টেস্ট সিরিজ চলছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজে, নেটে ব্যাট করছেন বীরেন্দ্র শেবাগ, পায়ে পায়ে নেটের কাছে এলেন গুরু গ্রেগ চ্যাপেল, কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর শেবাগকে কাছে ডাকলেন, বললেন, ‘বীরু, তোমার পা বল এর কাছে যাচ্ছেনা, একটু স্ট্রেচ করো পা টা, পিচে যাও।’
বীরু একটা ওভার ঐভাবে খেললেন, তারপর আবার ফিরে এলেন, ‘কোচ, আমার ঠিক কমফর্টেবল লাগছে না।’
রেগে গেলেন গ্রেগ, ‘তুমি যদি রান পেতে চাও যেভাবে বলেছি সেভাবেই খেলতে হবে’ লেগে গেলো তর্কাতর্কি, বীরু বললেন, ‘আমি আমার মতোই খেলবো, পছন্দ না হলে ড্রপ করে দেবেন।’
হাওয়া গরম দেখে দৌড়ে এলেন রাহুল দ্রাবিড়, বীরু কে বললেন, ‘বীরু, কোচ যা বলছেন সেটাই করো।’
পরের দিন টেস্ট ছিল, লাঞ্চ এর সময় যখন বীরু ড্রেসিং রুম এ ফিরলেন, নিরানব্বই নট আউট, কোচ কে গিয়ে বললেন, ‘আমার পা এগোক কি না এগোক, দিন এর শেষে রান আমি ঠিক এ করবো।’
শুনতে বেশ রোমহর্ষক লাগে, কিন্তু ভাবতে বসলে অবাক হয়ে যেতে হয়, পোর্ট অফ স্পেন হোক বা কেনিংটন ওভাল, ক্যারিবিয়ান দ্রুতগতির দানবদের সামনে পা না নড়িয়ে লাঞ্চ এর আগে নিরানব্বই? বলেন কি!
সাধারণত প্রথম ওভার এর প্রথম বলটা ফেস করা কঠিন হয়, যেমন বিরাট কোহলি বলেছিলেন, আমি প্রাথর্না করছিলাম, বিশ্বকাপ ফাইনাল এ মালিঙ্গার প্রথম বল টা যেন ইয়র্কার না হয়, একবার বল ব্যাট এর মাঝে লাগুক, বাকিটা বুঝে নেবো।
যেটা কেও ভাবেনা যে বোলার এর মাথা তেও একই জিনিস চলে, যেন প্রথম বল এ বাউন্ডারি না হয়, বীরু ঠিক সেই জিনিস টা ই করতেন, দেড়শোর ব্রেট লিই হন বা একশো ষাটের আখতার, বল হয় আছড়ে পড়তো এক্সট্রা কভার বাউন্ডারি টা অথবা ফাইন লেগের গ্যালারি তে, আশ্চর্যের ব্যাপারটা হলো এই মাইন্ডসেট টা নিয়ে বহুবার অনেক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু দক্ষতা? ঠিক কত টা প্রতিভাবান হলে দেড়শো কিলোমিটার গতি র বাউন্সার, প্রথম ফেস করা বলে কেও ফাইন লেগে এ ছয় মারতে পারে?
ভিভ কে করা একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম, ওনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ক্যারিবিয়ান কোয়ার্টেটকে (রবার্টস, হোল্ডিং, গার্নার, মার্শাল) ফেস করতে হলে আপনি কি হেলমেট পড়তেন? ভিভের সটান উত্তর, না, কখনোই না।
বীরুর হেলমেট ছিল, কিন্তু মানসিকতা র বদল ছিল না, যেখানে ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যান দের স্লো উইকেট এ টাইমিং এ সামান্য হেরফের হলেই তাদের আত্মবিশ্বাস এ খোঁদল দেখা দিতো, সেখানে বীরু’র সবথেকে বড় স্কিল ছিল তার অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস, যার মধ্যে দ্বিধার লেশমাত্র ছিল না
মাঝে মাঝে মনে হয়, আজকের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের টেমপ্লেটটা বীরুই সেট করে গেছেন, জয়সুরিয়া-কালুভিথারানা, হেইডেন-গিলক্রিস্ট রা যখন টসের সময় ক্যাপ্টেন এর মনে ভয় ধরাতেন যে ব্যাট নেবো না বল, ভারতের হয়ে সেভাবে ব্যাট করার কেও ছিল না, বছর দশেক পর কিন্তু ক্যাপ্টেন সহ দুনিয়ার তাবড় বোলাররাও একজন কে প্রথম ওভার করতে ভয় পেত, বীরেন্দ্র শেবাগ।
সেদিন একটা তর্ক হচ্ছিলো, পঞ্চাশের দশক এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর সামনে ইঞ্জিনিয়ার এর টেস্ট এ একশো তিরিশ স্ট্রাইক রেট, ঠিক কতটা ভালো? বাকিদের থেকে সেটা কিসে আলাদা ছিল? মানসিকতা না দক্ষতা?
বীরু র কিন্তু দুটোই ছিল, ঐজন্য ভারতের সর্বকালের এর সেরা টেস্ট দল বানাতে হলে বীরু’র মতো একজন নন ক্ল্যাসিকাল ব্যাটসম্যান যে উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে হেসেখেলে বিজয় মার্চেন্ট এর আগে ঢুকে যাবেন, এটা ভাবতে গেলেন নিতান্তই আশ্চর্য হতে হয়।
আশ্চর্য হওয়ার আরেকটা গল্প বলি, ২০০৮ শ্রীলঙ্কা সফর, অজন্তা মেন্ডিসের ঘূর্ণিজালে পর্যুদস্ত ভারত, জোরালো ভিডিও সেশন চলছে, ওকে পিক করার জন্যে সবাই চেষ্টা করছেন, মিনিট চল্লিশেক পর বীরু বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন, সবাই জিজ্ঞেস করলো, একি, তুমি চললে কোথাই? বীরু বললে না, আমার দেখা হয়ে গেছে।
না রথী মহারথী রা আবার মেন্ডিসের জালে ধরা দিয়েছিলেন, কিন্তু বীরু নিজস্ব ‘স্পিনার সমীহের যোগ্যতা নই ভঙ্গিমা’-তে তাঁকে যথেচ্ছ তুলোধোনা করতে ছাড়েননি।
ম্যাচ এর পর রবি শাস্ত্রী টিম মিটিং এ বলেন, বীরু দা ওয়ে ইউ পিকড মেন্ডিস ওয়াস এমেজিং, ইউ ওয়ের গেটিং ইন দা লাইন এন্ড স্ম্যাশিং ইট, গাইড আস থ্রু ইট। জানেন বীরু কি বললেন? ‘কুছ নেহি, বাস বাল্লে পার বল আ রাহি থি’
সবাই স্তম্ভিত!
পরে জানা গেছিলো মেন্ডিসের গুগলির সময় নাকি কড়ে আঙুল সামান্য ওপরে ওঠে সেটা বীরু দেখেছিলেন, তারপর এমন মারেন যে অধিনায়ক মাহেলা কে এসে ওনাকে বলতে হয় শুধু লেগ আর অফব্রেক করতে, খুব ছোট্ট জিনিস, কিন্তু এই ভিশনটাই বীরু স্পেশাল
উনি বলতেন, ‘শচীন-দ্রাবিড় রা ৪০০-৫০০ বল খেলতেন নেট এ, আমি ৪০ টা খেলতাম, আমি জানতাম আমি ম্যাচ এও এইভাবে খেলবো তাই নেট ও এভাবে করবো, ঐভাবেই আমার কনসেন্ট্রেশন আসতো, ঐ ভাবেই আমার জোন তৈরী হতো’ এই বক্তব্য শুনে আর বীরু র চিন্তাধারা শুনে মনে হয় যদি লারা আর ডি ভিলিয়ার্স খেয়ালি জিনিয়াস হয়, বীরু কি?
খেলার সময় কিশোর কুমার এর গান শিস দেওয়া খুব পছন্দের ছিল বীরু র, সুর ভুলে গেলে আবার টুয়েল্ভথ ম্যান কে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন জেনে আসতে, ব্যাটিং টা ও কিশোর কুমার এর গান এর মতো ছিল, ধ্রুপদি স্ট্রোকপ্লে ছিলোনা, জন্মগত ফুটওয়ার্ক ছিলোনা, তবু সবকিছু র মধ্যে একটা অদ্ভুত দাপট মাখানো ভালোবাসা জড়ানো ছিল।
আজ, এখনো মনে হয়, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ঐ বৃষ্টিভেজা দুপুরে যখন হাতে নতুন বল টা নিয়ে ম্যাট হেনরি দৌড়ে আসছিলেন, তখন উইকেট এর ওপাশ থেকে একটা কিশোর কুমার এর সুর এর গুনগুন শোনা গেলে হয়তো বড্ড ভালো হতো, হয়তো।