ফুটবল হল গোলের খেলা।
দিন শেষে যে দল বেশি গোল দেবে সেই দলই জিতবে এবং যে খেলোয়াড় গোল করবে তাকেই মনে রাখবে ফুটবল সমর্থকরা। এখনকার সময়ে ফুটবলে গোল বন্যা দেখা যায়। ক্লাব ফুটবলে একজন ফুটবলার যেমন গোল করেন জাতীয় দলের জার্সিতে সেই রুপ একটু কমই দেখা যায়। তাঁর কারণ হতে পারে ক্লাবে ট্যাকটিক্স থেকে বের হয়ে জাতীয় দলের ট্যাকটিক্সে দ্রুতই মানিয়ে নিতে না পারা।
গোলের রেকর্ডের কথা বললে আসবে ইউরোপিয়ান ফুটবলের সেই কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের মালিক একজন এশিয়ান। হ্যাঁ, একজন এশিয়ান। শুনতে একটু বিস্ময়কর হলেও সত্য। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন ইরানের কিংবদন্তি ফুটবলার আলি দাই।
আলি দাই মাঠে নামা মানেই ছিল তিনি গোল করবেন। আর গোল করার সেই কাজটি বেশ সাবলীল ভাবে করে গেছেন তিনি। জাতীয় দলের প্রতি ছিল তাঁর আবেগ, আর সেই কারণেই ক্লাব ফুটবলে নিজের নাম স্থাপন করতে পারেননি তিনি। তবে হ্যাঁ, এটা নিয়ে আফসোস না থাকাটাই স্বাভাবিক তাঁর, কারণ সে যে একজন আন্তর্জাতিক তারকা।
ইউরোপিয়ান ফুটবলকে না কাঁপানো একজন হলেন আলি দাই। ক্লাব ফুটবলে আপনি তাকে মেসি কিংবা রোনালদোর সাথে তুলনা করতে পারবেন না। কারণ তাদের মত ইউরোপিয়ান ফুটবল কিংবা ক্লাব ফুটবলে ভূরি ভূরি গোল করেননি তিনি। তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেসি-রোনালদোর থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আছেন আলি দাই। কারণ ফুটবলের আন্তর্জাতিক ইতিহাসে তিনিই যে সর্বোচ্চ গোলদাতা।
আলি দাই ইরানের ফুটবল ইতিহাসের একজন কিংবদন্তি ফুটবলার।
তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যেভাবে খেলছেন তাতে হয়তো বেশি দিন এই রেকর্ড থাকবে না। তবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে তাঁর নাম লেখা থাকবে কারণ তিনিই প্রথম ফুটবলার যিনি কিনা আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। পেলে, ম্যারাডোনা, পুসকাসের মত তারকারা যেখানে এই মাইলফলকের ধারের কাছেও আসতে পারেননি সেখানে নিজেকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। এশিয়ার এক দেশ থেকে এসে ফুটবলে রাজত্ব করা চারটি খানি কথা না। আর সেই কঠিন কাজটিই করেছেন আলি দাই।
আলি দাইয়ের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু ইরানের ক্লাব এস্টেঘলাল আরাবিলে। এখানে বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক দলে খেলেন তিনি। পাঁচ বছর বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক দলে খেলে খেলে এক মৌসুম মূল দলে খেলেন তিনি। এর পর এস্টেঘলাল আরাবিল ছেড়ে পাড়ি জমান তেহরান ভিত্তিক ক্লাব ট্যাক্সিরানি এফসিতে। ট্যাক্সিরানি এফসিতে ছিলেন মাত্র এক মৌসুম। এরপর আবারো ক্লাব ছেড়ে যোগ দেন তেজারাট এফসিতে।
তেজারাট এফসিতে থাকাকালীন সময়ে নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটান তিনি। এখান থেকেই পরিচিত পাওয়া শুরু করেন তিনি। এখানে চার মৌসুমে খেলেন মাত্র ৭৫ ম্যাচ। মৌসুমের হিসেবে ম্যাচের পরিমান বেশ কম। প্রতি মৌসুমে গড়ে ২০ টারও কম ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তেজারাট এফসির হয়ে করেছেন ৪৯ গোল। লিগের স্ট্রাকচার, ইনজুরি এবং জাতীয় দলকে সময় দেয়ার কারণে ক্লাব ফুটবলে সময় দিতে পারেননি তিনি।
তেজারাট এফসিতে খেলার সময় নজর কাড়েন তিনি। এরপরেই যোগ দেন তেহরানের আরেক ক্লাব পারসোপেলিস এবং কাতারের আল-সাদে। এখানে থাকাকালীন সময়ে ক্যারিয়ারে স্বর্ণালী সময় পার করেন তিনি। পারসেপোলিসে থাকাকীলন সময়ে জাতীয় দলের হয়ে ১৮ ম্যাচে ২২ গোল করেন। এরপরেই তার উপর নজর পড়ে কাতারের ক্লাব আল-সাদের।
পারসেপোলিসে থাকাকালীন সময়ে এশিয়া কাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন তিনি। ৮ গোল করে এএফসি এশিয়া কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে ইরান সেমি ফাইনালে পেনাল্টি শুট আউটে সৌদি আরবের কাছে হেরে বিদায় নেয়। তাঁর এই দুর্দান্ত পারফর্ম এশিয়ার সেরা ফুটবলারের রানার-আপ ট্রফি এনে দেয় তাকে।
এশিয়া কাপের পর আল-সাদে যোগ দেন তিনি। কিন্তু আল-সাদের হয়ে বেশিদিন খেলতে পারেননি আলি দাই। আল সাদে খেলার সময়ই ডাক আসে ইউরোপে খেলার। জার্মান দ্বিতীয় স্তরের ক্লাব আর্মিনিয়া বিয়েলেফেল্ডে যোগ দেন। এখানে দেখার বিষয় ছিল তিনি ইউরোপে কতটা ভালো খেলতে পারেন তিনি। এখানে যোগ দেয়ার পরই ক্লাব জার্মান বুন্দেসলিগায় উঠে আসে। এখানে মাত্র ২৫ ম্যাচে ৭ গোল করেন আলি দাই। কিন্তু আর্মিনিয়া বিয়েলেফেল্ড বুন্দেসলিগাইয় টিকে থাকতে পারে নি। এক মৌসুম পরেই আবারো নিচের স্তরে নেমে যায় আর্মিনিয়া বিয়েলফেল্ড। জাতীয় দলে সময় দেয়ার কারণে ক্লাবে সময় দিতে পারেননি তিনি।
১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপকে লক্ষ্য রেখে আলি দাইকে কেন্দ্র করে দল সাজিয়েছিল ইরান। এই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে নয় গোল করে ইরানকে বিশ্বকাপের মূল পর্বে নিয়ে যেতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখেন। অস্ট্রেলিয়াকে ঘরের মাঠে ১-১ গোলে ড্র করে ইরান। সেখানেও গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা ছিল আলি দাইয়ের। ফিরতি লেগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গোল করে ইরানকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে নিয়ে যান আলি দাই।
বিশ্বকাপে ইরানের পারফর্মেন্স বেশ সাদা মাটা। এর মধ্যেও স্বাগতিক আমেরিকাকে ২-১ গোলে হারায় আলি দাইয়ের ইরান। এই বছরেই এশিয়ার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন আলি দাই। তিনি এই শিরোপা জিতেছিলেন মাত্র এক বার।
ঘরোয়া ফুটবলে নিয়মিত না খেলা এবং বাজে পারফর্মেন্সের পরও তাকে দলে ভেড়ায় জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ। বায়ার্ন মিউনিখে এসে বেশিরভাগ সময়ে বেঞ্চে কাটাতে হয়েছে। যদিও মাত্র এক মৌসুম খেলেছেন বায়ার্ন মিউনিখে। বাভারিয়ানদের হয়ে ৩১ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল। এছাড়াও প্রথম কোনো ইরানি ফুটবলার হিসেবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছেন। এক মৌসুম পরেই বাভারিয়ান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে যোগ দেন আরেক জার্মান ক্লাব হার্থা বার্লিনে। এখানে ছিলেন দুই মৌসুম।
হার্থা বার্লিনেও খুব বেশি ভালো খেলতে পারেননি । হার্থা বার্লিনে দুই মৌসুম কাটানোর পর ফিরে আসেন এশিয়াতে। এশিয়াতে এসে যোগ দেন আরব আমিরাতের ক্লাব আল-শাবাবে। আল-শাবারের হয়ে ২৩ ম্যাচে ১১ গোল করেন তিনি। এরপর আবারো ফিরে আসেন নিজ মাতৃভূমি ইরানের ক্লাবে।
ক্লাব ক্যারিয়ারে বেশি কোনো সাফল্য নেই। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে সবসময়ই দুর্দান্ত একজন ফুটবলার ছিলেন তিনি। ২০০০ সালে আবারো এক বছরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ২০ গোল করেন আলি দাই। এইভাবেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে নতুন করে রেকর্ড গড়া শুরু করেন আলি দাই। ২০০৩ সালে লেবাননের বিপক্ষে গোল করে পুস্কাসকে পিছনে ফেলেন তিনি। তখন পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারে নি আলি দাই ভেঙে দিবে সবার রেকর্ড।
২০০৬ বিশ্বকাপের সময় আবারো জার্মানিতে ফে রেন তিনি। তখন খেলতে যান বিশ্বকাপ। ৩৬ বছর বয়সী আলি দাই বিশ্বকাপে ভালো খেলতে না পারলেও বাছাই পর্বে দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। বাছাই পর্বে ৪ গোল করেন তিনি।
আলি দাই ফুটবল ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান ২০০৭ সালে। এর সময়ের মধ্যে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। যা এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ভবিষ্যতেও এই রেকর্ড অক্ষুণ্ণ থাকবে কিনা সেটা বলা যায় না। তবে তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ফুটবল ক্যারিয়ারকে বিদায় জানালেও ফুটবলের সাথেই আছেন আলি দাই। তিনি এখন কোচিং করাচ্ছেন বিভিন্ন ফুটবল দলকে।