ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের ম্যাচ থাকলে এমআরএফ ব্যাটটা হাতে এক যুবক ব্যাট করতে নামলে শহীদ মিনারের কাছ থেকে শব্দব্রহ্মটা এখনো কানে আসে। তফাতের মধ্যে তিন অক্ষরের শব্দটা, যেটা শব্দব্রহ্ম হয়ে কানে আসে সেটাই ইডেন জনতার কাছে ‘স্যা… চি… ন… স্যা… চি… ন’ থেকে কিভাবে যেন পরম্পরা বদলে ‘বি… রা… ট… বি… রা… ট’ হয়ে গেছে, ঠিক যেমন ভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যানের পরম্পরাটাও নীরবে হস্তান্তরিত হয়ে গেছে মুম্বাইয়ের বেঁটেখাটো লোকটার থেকে দিল্লীর ডাকাবুকো যুবকের কাছে।
এই নীরবে ব্যাটনটা হস্তান্তর হওয়া যদিও একদিনে হয়নি, মুম্বাইকরের অনেক তপস্যা, সাধনা, শৃঙ্খলার অংশগুলো টুকরো কোলাজে যেন কোনো এক বিরাট কোহলির মধ্যে প্রবেশ করেছে, আর সেইগুলো দিয়ে বিরাট তাঁর কীর্তি কলাপ স্থাপন করে চলেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমাতেই।
বিরাট ভঙ্গিমা তাঁর পুরোপুরিই স্বতন্ত্র, যেখানে গুরু শচীনের তপস্যা, শৃঙ্খলা, স্কিল আর টেকনিকের সাথে মিশে আছে স্যার ভিভ রিচার্ডসের মতোই বিপক্ষকে ছিঁড়ে খাওয়ার মানসিকতা, ব্যাট নামক অস্ত্র দিয়ে বোলারদের ক্রমাগত শাসন করে যাওয়া। তাই কোথায় গিয়ে যেন বিরাট এক অদ্ভুত ক্রিকেট দর্শনে বিশ্বাসী রাজা, যেখানে মুম্বাইয়ের বরপুত্রের সাথে অ্যান্টিগার রাজপুত্রর মিশেল ঘটে গেছে অজান্তেই।
বিরাট রাজার এই ক্রিকেট দর্শনের শুরু সেই ১৭ বছর বয়সের দিল্লী-কর্ণাটক রঞ্জি ম্যাচের থেকেই, যেখানে বাবার মৃত্যুকে বুকে চেপে রেখে ছেলেটা দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে ৯০ রানের ইনিংস খেলে যায়। কারণ তাঁর বাবা চাইতেন ছেলে বড়ো ক্রিকেটার হন, সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েই বোধহয় এই দর্শনের শুরু।
আর বিরাটের কাছে তো ক্রিকেটকে অসমাপ্ত রেখে আসাটা অপরাধ আর কোনোকিছুর জন্যই তাই ক্রিকেটকে বিসর্জন দেওয়া যায়না। এটাই বিরাট, এটাই বিরাট দর্শন। বিরাট এটাই, যিনি নিজের ভুল ত্রুটি থেকে ক্রমাগত শিক্ষা নিতে পারেন আর সেখান থেকে একটা একটা সেঞ্চুরির মতো ইমারত দিয়ে নিজের সাম্রাজ্যকে তৈরী করতে পারেন।
বিরাট সাম্রাজ্যের ভিত্তি যদি দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর ইস্পাত কঠিন মানসিকতা, তাঁর স্কিল, তাঁর দৃঢ়তার ওপর, সেই ভিত্তির আরেকটা দিক হলো ফিটনেস আর ডায়েটিং। বিরাটের মত ফিটনেস সচেতন ক্রিকেটার ভূ ভারতে কেন পৃথিবীতেও বোধহয় বিরল। তাঁর মন্ত্র হলো জিম দেবে পাওয়ার আর ডায়েট দেবে ফিটনেস, এই দুয়ের সংমিশ্রনে বিরাট হবেন তেজিয়ান ঘোড়া, যিনি যেকোনো যুদ্ধ জয় করতে একটুও পিছপা হবেন না।
বিরাট মন্ত্রে তাই এক রানকে দু’রানের জন্য ক্রমাগত দৌড়ানো আছে, হাফ চান্স কেন কোয়ার্টার চান্সকেও ক্যাচিংয়ে পরিণত করার ভাবনা আছে, প্রতিদিন বদলে যাওয়া খেলাটার সাথে আরো অ্যাডভান্স চিন্তা ভাবনারও প্রক্রিয়া ঐ বিরাট দর্শনেই বিদ্যমান।
বিরাট দর্শন শেখেনি কোনোদিন হারতে, যে ছেলেটা একদিন দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৪ দলেও নির্বাচিত হতে পারেনি দুর্নীতির কবলে, সেই ছেলেটাই এরপর বুকে জেদ চেপে ব্যাট হাতে অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা করতে করতে পৌঁছে যায় অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে। আর সেখানে অধিনায়ক হয়ে দুরন্ত ব্যাটিং করে বিশ্বকাপটাই জিতিয়ে আনেন তাঁর নিজের স্বতন্ত্র আগ্রাসনে।
হারতে না শেখা বিরাট ভারতীয় দলের মূলস্রোতে আসার পরেও হারিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসেছেন কয়েকবার। আর তারপর স্টার্ক, জনসন, রাবাদা, কামিন্স, বোল্ট, আর্চার, স্টেইনদের সামনে বছরের পর বছর হয়ে উঠেছেন মূর্তিমান বিভীষিকা। বিশ্বব্যাপী বোলারদের কাছে তিনি যদি হন রাতের দুঃস্বপ্ন, কোটি কোটি ভারতবাসীরা কাছে বিরাট কোহলি নামটা রঙিন সুখ স্বপ্ন দেখার খোরাক।
বিরাট মহিমা তো এখানেই; তাই তো বিরাট মানে লড়াই, বিরাট মানে আগ্রাসন, বিরাট মানে ভরসা, বিরাট মানে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া, বিরাট মানে স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য এর এক জলজ্যান্ত প্রতিমূর্তি, বিরাট মানে যুব সমাজের আইডল, বিরাট মানে পর্বত প্রমাণ রান তাড়া করা কেও তুচ্ছ করার সাহস, বিরাট মানে ৯০ এর ঘরে ব্যাট করার সময় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, বিরাট মানে অ্যাডিলেড ওভালের বুক চিরে কবিতা লেখা কভার ড্রাইভ, বিরাট মানে ব্যাটিং লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে নতুন করে প্রেমে পড়ার উপাখ্যান, বিরাট মানে সর্বোপরি নতুন ভারতের জয়গান।
তাই তো বিরাট রাজার আপন দেশে, শতকোটির স্বপ্ন মেশে।