তাঁর বাম হাতের মধ্যাঙ্গুলিতে একটা ছোট্ট ট্যাট্যু করা আছে।
ছোট্টই বলতে হচ্ছে। কারণ পুরো শরীর ভরা ট্যাট্যুর মাঝে এই ট্যাট্যুকে ছোট্টই মনে হয়। সারা শরীর তাঁর উল্কিতে ভরা। আর তার মাঝে এই লালরঙা ট্যাট্যুর মাহাত্ব্য একটু অন্যরকম। বামহাতের মাঝ বরাবর লেখা ‘90’ আর তার একটু উপর ক্রুশের মতন করে একটা পাস চিহ্ন সবমিলিয়ে ‘90+’। নিজের ধর্ম আর কর্ম আগলে রেখেছেন নিজের হাতের কাছে।
প্রতিটা হিরো’স জার্নিতে হিরোর একটা লোয়েস্ট পয়েন্ট থাকে। যে মুহুর্ত থেকে শুরু হয় হিরো’স জার্নি। যে একটা মূহুর্ত ডিফাইন করে দেয় তাঁর ভবিষ্যৎ। একটা মূহুর্ত বদলে দেয় জীবনের গতিপথ। ‘গ্ল্যাডিয়েটরে’ ম্যাক্সিমাসের স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে সেনাপতি থেকে গ্ল্যাডিয়েটর হওয়া, ‘লর্ড অফ দ্যা রিংসে’ সারুমনের কাছে বিধ্বস্ত হয়ে গ্যান্ডালফ দ্যা গ্রের গ্যান্ডালফ দ্যা হোয়াইট হওয়া কিংবা ‘স্টার ওয়ার্সে’ আঙ্কেল ওয়েন আর বেরুর মৃত্যুর পর ট্যাট্যুইন ছেড়ে অনন্তের পথে ওবি-ওয়ানের সাথে লুকের পা বাড়ানো; সবটাই হিরো হওয়ার সূচনা।
২০১২ চ্যাম্পিয়নস লিগের পেনাল্টি মিসকে সে তালিকাতেই ফেলা যায়। সার্জিও রামোসের জীবনের লোয়েস্ট পয়েন্ট ছিল সম্ভবত ওটাই। সম্ভবত না, অবশ্যই। বায়ার্নের বিপক্ষে সেদিন সিন্দাবাদের ভূত ভর করেছিল রিয়ালের। নইলে কাকা, রোনালদো, রামোসের মতন পেনাল্টি স্পেশালিস্টদের কেউই জালের দেখা পাননি? তার পরপর? একই দিনে? উপর থেকে কেউ একজন চিত্রনাট্য লিখছিলেন আপনমনে। যে চিত্রনাট্যে রামোসের জীবন ডিফাইন করে দেওয়া মুহূর্ত তিনি সাজিয়েছেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে।
রামোসের জীবনটাকে ঠিক দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বায়ার্নের বিপক্ষে পেনাল্টি মিসের আগে আর পরে। রামোসের প্রথম জীবন ছিল ক্লাসের মাঝারি মানের একটা ছাত্রের মতন। লম্বা চুল, ক্লিন শেভড। ঠিক টিপিক্যাল গুডবয় নন, ব্যাড বয় হিসেবে ইমেজ আছে ঠিকই কিন্তু লিডার নন। কোনো কাজেই ঠিক এক্সপার্ট নন, তবে উদ্দীপনায় ভরপুর। কোনো কাজে দরকার পরলে ঠিকই প্রথম সারিতে পাওয়া যায় তাঁকে। স্বপ্নটা অনেক বড়, বিশ্বজয় করার।
নইলে কী মাত্র ১৮ বছর বয়সে সেভিয়া প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে মুখ বড় করে বলতে পারেন, আমি এই দলের অধিনায়ক হতে চাই? প্রেসিডেন্ট তার কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন তুড়ি মেরে। ঘরের ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি আর যাই হোক কোনোদিনও সেভিয়ার অধিনায়কত্ব পাবে না। তার কথা ফলেছে ঠিকই। সেভিয়ার আর্মব্যান্ড হাতে ঝুলানোর সাধ্য হয়নি তার। কিন্তু ঠিকই হয়েছে স্পেন আর স্পেনের সেরা দল রিয়ালের আর্মব্যান্ড হাতে ঝুলানোর।
এই রিয়ালে যোগ দিয়েছিলেন রাউল-জিদান-বেকহ্যামের মিলে চমকে। এক ফ্রি-কিকে মন কেড়ে নিয়েছিলেন রিয়াল ড্রেসিং রুমের। যে কারণে গত ১৬ বছর ধরে এখনও রিয়ালের সবচেয়ে দামী স্প্যানিশ ডিফেন্ডারের নাম সার্জিও রামোস।
২০১২ পরবর্তী রামোস যেন সেই রূপের প্রতিরূপ। এক সেমিফাইনাল হার তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছিল কয়েক পা। রামোসের স্পিরিট রামোসকে ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে দিয়েছিল কয়েক পা। রামোসের সামনে খোলা ছিল মাত্র দুটো পথ, হয় এই প্রেশার নিরে না পেরে ভেঙ্গে পরা। পৃথিবীর ইতিহাসে হাজারো ডিফেন্ডারদের সাথে নিজের নাম লেখানো। কিংবা, দুই পা পিছিয়ে পরা থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে ইতিহাসের চূড়ায় পৌঁছানো। রামোস দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলেন। শুরু হলো হিরো’স জার্নি।
রামোস ক্যারিয়ারের প্রথমভাগে হয়তো ছিলেন মাঝবেঞ্চের মিডিওকার একজন ছাত্র মাত্র। কিন্তু মাঝবেঞ্চের বসেই নিজের ক্যারিয়ার লিখেছেন তিনি। ব্যাকবেঞ্চার পুয়োল-পেপেদের কাছ থেকে শিখেছেন কীভাবে দলের প্রয়োজনে নিজের জান দিতে হয়, সামনের বেঞ্চের ক্যাসিয়াস-ইনিয়েস্তাদের কাছ থেকে শিখেছেন কীভাবে দলের প্রয়োজনে দলকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। দুইয়ের মিশ্রণে রামোস হয়েছেন এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি।
টিক টিক, টিক টক! ঘড়ির কাঁটা আস্তে আস্তে এগুচ্ছে সমাপ্তির দিকে। ম্যাচের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সমর্থকেরা আনন্দ মিছিল বের করবে বলে অপেক্ষারত। মদ্রিচ নিলেন; রামোস এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। ডি-বক্সের বাইরে থেকে ছুটে এসে অ্যাটলেটিকোর গলায় বসিয়ে দিলেন মরণ কামড়। তৈরি হলো ইতিহাস, রামোস হয়ে থাকলেন মিস্টার ৯২.৪৮! পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত নেই যে প্রান্ত থেকে রিয়াল সমর্থকদের চিৎকার শোনা যায়নি।
১২ বছরের প্রতীক্ষা, না পাওয়ার আর্ত্মচিৎকার একবারে বের হয়েছিল রামোসের স্বর দিয়ে। ফাইনাল তখনও নিশ্চিত হয়নি, কিন্তু রামোসের হিরো’স জার্নি ততক্ষণে পথ খুঁজে পেয়েছে দিশা। রামোস হয়ে উঠলেন কমিক বুকের স্ট্রিপ থেকে উঠে আসা এক চরিত্র। স্যান্সি হেয়ারকাট, মুখভর্তি চাপদাড়ি, হাতে আর্মব্যান্ড; দ্যা লিডার সার্জিও রামোস! তিন মৌসুম আগেও যে রামোস মাটিয়ে লুটিয়ে পরেছিলেন হতাশায়, ক্যাসিয়াসকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরেছেন কান্নায়, সেই রামোসই দুই বছরের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়ে হয়ে গিয়েছেন রিয়ালের ত্রাতা, রয়্যাল মাদ্রিদের রয়্যাল লিডার!
ক্যাসিয়াস চলে যাওয়ার পর যে শূণ্যতা, অভাব তৈতি হয়েছিল রিয়ালের বুকে, সেই জায়গা নিতে এসেছিলেন রামোস। ক্যাপ্টেন্সির আর্মব্যান্ড হাতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে নেমেছেন উঠেপরে। ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারে বলার মতন কোনোকিছুই বাকি নেই তার। পুয়োল, ক্যাসিয়াস, জাভি, ইনিয়েস্তাদের সাথে স্পেনের ড্রিম টিমের সদস্য ছিলেন তিনি। ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জিতেছেন দলের ডিফেন্সের মূল স্তম্ভ হয়ে। তবুও রামোসের গ্রেটনেস নিয়ে কথা বল্বার লোকের ছিল বড্ড অভাব। দিনশেষে রেকর্ডবুকে তাঁকে সর্বকালের সেরা বলবার মতন স্ট্যাট কিংবা রেকর্ড নেই। রামোস টার্গেট করলেন সেটাকেই।
একজন গুড আর গ্রেট খেলোয়াড়ের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় ক্লাচ মোমেন্টে তাদের পারফরম্যান্স। রামোস তার পাশার দান চেলেছেন সেখানেই। ২০১৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের গোল তো সবারই জানা। সে মৌসুমের সেমি ফাইনালেও বায়ার্নকে একাই ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায়।
২০১৬ ফাইনালে একমাত্র গোল, সুপারকাপ ফাইনালে ৯৩ মিনিটে গোল, বার্সেলোনার সাথে ৯২ মিনিটে হেডার; গত চার মৌসুমে ৭৫ মিনিটের পর রামোসের আছে মোট ১৪ গোল। প্রতিটা গোলই হয় দলকে জিতিয়েছে, নইলে বাঁচিয়েছে নিশ্চিত হার থেকে। তাই রামোস যখন নিজের হাতে ৯০+ লিখে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে করেন সেটাকে কমই মনে হয়।
নিজের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে জিতেছেন থ্রি-পিট, এমন এক সম্মান যা পৃথিবীর অন্য কোনো অধিনায়ক পূরণ করা দূরে থাক, স্বপ্নও দেখতে পারেনি। রামোস পেরেছেন। রাউল-ক্যাসিয়াসের রেখে যাওয়া রয়্যাল ক্লাবকে নিজের করে নিতে। রামোস রিয়ালের বাড়ির ছেলে নন। সেভিয়ার সন্তান। অথচ তাঁকে দেখে কে বলবে তার বাড়ি রিয়াল নয়? রিয়ালের জন্য রক্ত ঝড়িয়েছেন গা থেকে, মারামারি করে লাল কার্ডের বন্যা বইয়েছেন। আবার সেই রিয়ালকেই আগলে রেখেছেন নিজের জীবনের আরেকটা অংশ হিসেবে।
গত মৌসুমেই যেমন লোপেতেগি-সোলারি অধ্যায় শেষে জিদান যখন ফিরলেন ততদিনে রিয়াল তীরহারা তরী। এর মধ্যেই হানা দিলো করোনা। করোনার প্রভাগ শেষে রামোস যখন মাঠে ফিরলেন, চেহারাটা ছিল মনে রাখার মতন। নর্স মিথলজি থেকে তুলে আনা কোনো এক দেবতা যেন। মুখভর্তি দাড়ি, লম্বা চুল। যেভাবেই তাকান না কেন, দেখে তাঁকে নর্স গড ছাড়া অন্য কোনো কিছুই লাগবে না।
রামোস পেরেছিলেন, ফেরত এসে রিয়ালকে আরেকটা শিরোপাত মুখ দেখাতে। মৌসুমের শেষদিকে একেবারে দৈবশক্তি পেয়েছিলেন যেন। এখনও তাই আছে। ৩৫-এ পা দিয়েছেন আজ, তবুও মাঠে তাঁকে চিৎকার করতে দেখলে কোনোভাবেই ২৭-এর বেশি মনে হবে না তাঁকে। ক্যারিয়ারের এক বড় অংশ রামোসকে কাটাতে হয়ে অপবাদ শুনে, কার্ডের ছড়াছড়ি, মাঝে মধ্যেই ডিফেন্সে হাওয়া হয়ে যাওয়া, তার অনুপস্থিতিতে গোল খাওয়া; আরো কত কী? কয়লা চাপে পিষ্ট হয়ে হীরে হয়, রামোস ছিলেন সেই খাঁটি কয়লা যার মূল্য এখন হীরের চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নয়।
রামোস আর কতদিন খেলবেন জানা নেই। ৩৫-এ পা দেওয়ায় রিয়ালও ভাবতে শুরু করেছে তাঁকে নিয়ে। ডিফেন্ডারদের লঞ্জিভিটি দেখলে রামোসের এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। অথচ সামনে এত পথ বাকি থাকতেও ঠিকই সেরাদের কাতারে ইতিমধ্যে নাম লেখা শেষ তার। কার্লো আনচেলত্তির কথাটা তাই রামোসের সাথে খুব বেশি মানায়,
‘এক্সট্রা অর্ডিনারি ট্যাক্টিক্যাল অ্যাডভান্টেজধারী প্রচুর ডিফেন্ডার আছে, যেমন ক্যানাভেরোর মার্কিং, বারেসির ব্যাক লাইন কমান্ড। আর সবকিছুকে এক করে যদি কোনো ডিফেন্ডারকে খুঁজতে যান, তাহলে সেটা রামোস। ট্যাক্টিক্যাল অ্যাবিলিটি, স্ট্রেন্থ, পার্সোনালিটি, লিডারশিপ; সবকিছুর এক পারফেক্ট মিশ্রণ রামোস।’
দিনশেষে তাই ঘোর শত্রুরও স্বীকার করা লাগে, ‘Ramos is the perfect header, leader and he’s the after 90 decider!’