গ্ল্যামার নয়, ব্যাটে তাঁর পরিচয়

ভারতের ক্রিকেটে এখন প্রতিভাবান তরুণের অভাব নেই। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) বদৌলতে তো কখনো ভারতের হয়ে ম্যাচই খেলেননি এমন অনেক ক্রিকেটারও স্টার হয়ে উঠেছেন। তবে একজন আছেন যিনি রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে এই মুহুর্তে ভারতের অন্যতম সফল হয়েও তিনি হার্দিক পান্ডিয়া কিংবা ঋষাভ পান্তদের মত আলোচনায় আসেন না।

তিনি হয়তো গ্ল্যামারাস কোনো চরিত্র নন, হিরোর মত চেহারা, কিন্তু হিরোইজম নেই। হয়তো জার্সির পিছনের নামটার চেয়ে সামনের নামটাকে বেশি গুরুত্ব দেন বলে তিনি কখনো হিরো হয়ে উঠেন না। তবে তাঁর ব্যাট যে ভিষণ গ্ল্যামারাস, সে মাঝেমাঝেই চিৎকার দিয়ে বলে, ‘লোকেশ রাহুল, ইউ আর দ্য হিরো।’

এইতো দুদিন আগের পাঞ্জাব কিংস আর রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচটাই ধরুন না। পাঞ্জাবের এই অধিনায়ক আগে ব্যাট করতে নেমে ৫০ বলে ৯১ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে ফেললেন। তবে এই সংখ্যগুলো সেদিন আরো বড়ো হতে পারতো। তিনি চাইলেই আরো বেশি বল খেলে নিজের সেঞ্চুরিটা করে ফেলতে পারতেন হয়তো। তবে তিনি যে অধিনায়ক। বারবার স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন দিপক হুডা কিংবা ক্রিস গেইলদের।

তিনি শুধু বাইশ গজে থেকে অ্যাংকর রোল টা প্লে করতে চেয়েছেন। যাতে দল একটা বড় সংগ্রহ পায়। হয়েছেও তাই! রাহুল ক্রিজে আছেন এই ভরসায় ক্রিস গেইল, দিপক হুডারা হাত খুলে খেলেছেন। ফলে দলের বড় সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে। রাজস্থানকে ২২২ রানের টার্গেট দেয় পাঞ্জাব।

এই বড় সংগ্রহে ভর করে পাঞ্জাবও জয় পায়। তবে রাহুলের সেঞ্চুরিটা হয় না, তাঁর আর হিরো হওয়া হয় না। রাজস্থানের সাঞ্জু স্যামসন ৬৩ বলে খেলেন্ ১১৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। স্যামসন একটুর জন্য ম্যাচ না জেতাতে পারলেও হিরো ঠিকই হয়েছেন। তবে রাহুলের ওই জার্সির সামনের নামটার জন্য স্যাক্রিফাইস,তাঁর পরিকল্পনা এগুলো ক্রিকেটের পরিসংখ্যানে লেখা থাকে না। পরিসংখ্যানে শুধু রান গুলোই লেখা যায়,রাহুলদের আত্মত্যাগ নয়।

ভারতের হয়েও একই রকম সফল এই ওপেনার। বিশেষ করে রঙিন পোষাকে তিনি সেরাদের একজন। তবুও মাঝেমাঝেই তিনি একাদশে থাকেন না বিচিত্র সব কারণে। বিচিত্র বললাম কারণ আমি সত্যিই কোনো কারণ খুঁজে পাইনা। কেনো কারণ খুঁজে পাইনা এবার তাঁর একটু ব্যাখ্যা দিই। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই মুহুর্তে ভারতের সেরা ওপেনার তিনি।

শুধু ভারত কেন, বিশ্বক্রিকেটের সেরা বললেও পাপ হবার কথা নয়। ২০১৬ সালে অভিষিক্ত হবার পর এখন অবধি ৪৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। সেখানে প্রায় ৪০ গড়ে করেছেন ১৫৫৭ রান। এভাবে বললে ঠিক বুঝা যায় না তিনি কী করে সেরা ওপেনার হলেন।

টি-টোয়েন্টিতে অন্তত ১৫০০ রান করেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় বিশ্ব ক্রিকেটে শুধু দুইজনের। একজন তাঁরই অধিনায়ক বিরাট কোহলি। আরেকজন পাকিস্তানের বাবর আজম। এদের দুজনের থেকে আবার স্ট্রাইকরেটে (১৪২.১৯) এগিয়ে লোকেশ রাহুল।

ভারতের আরেক ওপেনার রোহিত শার্মাও ব্যাটিং গড় ও স্ট্রাইকরেট দুটোতেই অনেকটা পিছিয়ে তাঁর থেকে। তাছাড়া তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি চার বা চারের নিচে ব্যাট করতে নেমেও টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করেছেন। এই ৪৯ ম্যাচে ২টি সেঞ্চুরি ও ১২টি আফ সেঞ্চুরি আছে তাঁর ঝুলিতে। তবুও ভারতের ওপেনিং পজিশনে জায়গা পাননা তিনি। শোনা যায় এবছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রোহিত শার্মার সাথে ওপেন করবেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। ফলে রাহুল ওপেন করতে পারছেন না নিশ্চিত, তবে একাদশে থাকবেন কী!

ওয়ানডে ক্রিকেটেও একইরকম ভাবে উজ্জ্বল তিনি। ভারতের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের অভিষেক ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি করেন লোকেশ রাহুল। এখন পর্যন্ত খেলা ৩৮ ম্যাচে ৪৮.৬৭ গড়ে করেন ১৫০৯ রান। তাঁর ব্যাটিং গড় ভারতের বর্তমান ওয়ানডে দলের তৃতীয় সর্বোচ্চ।

তাঁর চেয়ে বেশি গড় শুধু বিরাট কোহলি ও রোহিত শার্মার। ফলে ওয়ানডেতেও যে এই মুহুর্তে তিনি ভারতের সেরা ওপেনার তা বলাটা ভুল হবেনা নিশ্চই। ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন অবধি পাঁচটি সেঞ্চুরি ও নয়টি হাফ সেঞ্চুরির মালিক তিনি। ৩৬ টেস্টেও আছে দুই হাজারের বেশি রান।

সবমিলিয়ে ভারতের নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময়ী ব্যাটসম্যান রাহুল। তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো তিনি একজন টিমম্যান এবং ভালো অধিনায়ক। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার অভ্যাসটা এখনই পাঞ্জাবের হয়ে গড়ে উঠছে। হয়তো এই অভ্যাসটা একদিন ভারতেও হয়ে কাজে লেগে যাবে। যত যাই হোক, একটা ক্রিকেট দলের তো গ্ল্যামারের চেয়ে বেশি একজন পারফর্মারই বেশি প্রয়োজন।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link