বৃষ্টিস্নাত রাতে রেকর্ডের ঝড়

ম্যাচ শুরুর ঘন্টাখানেক আগে থেকেই পুরো আকাশ ঢেকে গিয়েছিল কালো মেঘে। মাদ্রিদের আলফ্রেডো ডি স্টেফানো স্টেডিয়ামে যে ঝড় আসতে চলেছে তা যেকেউ দেখেই বলে দিতে পারবে। চেলসি-রিয়াল ম্যাচের আগে এমন উত্তাল বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে কোন দলই উড়ে যায়নি। তবে মাঠে বয়ে গিয়েছে রেকর্ডে ঝড়।

মেঘ দেখে মাদ্রিদ সমর্থকদের মনে চিন্তার পাহাড় জমেছিল বটে। কবিগুরুর কথা মতন ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। রিয়ালে মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে না, বরং মেঘের অন্তরালে মেঘের পাহাড় জড়ো হতেই থাকে। এমনিতেই চোটে জর্জর রিয়াল, তার উপর এই বৃষ্টিতে যে আরো কতেকজন এই পথে হাঁটবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ডিফেন্সের দুই স্তম্ভ নেই, একই ক্রুস-মদ্রিচ-ক্যাসেমিরো খেলে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটা দিয়ে দল সাজিয়েছিলেন জিদান, ৩-৫-২ ফরমেশনে। থ্রি-ম্যান ডিফেন্স, কার্ভাহাল-মার্সেলো খেলেছেন উইং-ব্যাক হিসেবে। থমাস টুখেল ভুল করেননি, ক্লান্ত পাগুলোকে দূর্বল করে দিয়েছিলেন নিজের অস্ত্র এন’গোলো কান্তেকে দিয়ে।

থমাস টুখেল হচ্ছেন জিনেদিন জিদানের মুখোমুখি হওয়া গুটি কয়েক কোচের মধ্যে একজন যাকে এখনও হারের স্বাদ দিতে পারেননি জিদান। জিদানের মতন সর্বজয়ী কোচের বিপক্ষে অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়েই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন টুখেল। সেটা করার ট্যাক্টিসও ছিল বেশ সরল-সোজা। এক কান্তেকে দিয়ে রিয়ালের মিড অচল করে দেওয়া।

জিদান সেখানে পরাস্ত হয়েছেনও। প্রথম আধ ঘন্টা খুঁজেই পাওয়া যায়নি জিদানের মিডফিল্ড। এমনিতেই ক্লান্ত মিডফিল্ড, তার উপর থ্রি ব্যাক থাকায় জিদান ভেবেছিলেন টুখেল চিরচারিত বাসপার্ক থেকে কাউন্টারে যাবেন। কিন্তু না, প্রথম থেকেই প্রেস করে গিয়েছেন রিয়ালের ডিফেন্সে। রিয়ালের ডিফেন্সও ভেঙে পরে ১০ মিনিটের মাথায়।

ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ গোল করে এগিয়ে নিয়ে যান চেলসিকে। সাথে সাথে নাম লেখা রেকর্ডবুকেও। প্রথম আমেরিকান খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে গোল করার রেকর্ড করলেন ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ। কর্তোয়াকে ড্রিবল করে তার পাশ কাটিয়ে ১৪ মিনিটের মাথায় যখন বল পৌছে দেন জালে, ততক্ষণে রেকর্ডবুকে নাম লেখা হয়ে গিয়েছে তার।

চেলসির সামনে রেকর্ড গড়ার সুযোগও কম ছিল না, কিন্তু এক কর্তোয়াই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল চেলসির সামনে। নিজেদের গড়া তারকা এভাবে নিজেদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে, সেটা অনুমিতই ছিল। একের পর এক আক্রমণে কর্তোয়া হয়েছেন চীনের প্রাচীর।

তবে রেকর্ডের বন্যা হয়ে এসেছিলেন করিম বেনজেমা। করিম বেনজেমা রিয়ালের জন্য কী করেছেন তা নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না। বয়সের কাঁটা ৩৩ ছাড়িয়েছে, তবু একটুও ক্লান্তি নেই চোখে মুখে। প্রতিটা ম্যাচ খেলে যাচ্ছেন সমান পরিশ্রমে। একসময় রিয়ালের ‘বিবিসি’ ছিল, লোকে তখন টিটকিরি মারতো তাকে নিয়ে।

বেল-রোনালদোর সামনে বেনজেমা নামটা ঠিক যায়নি। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রিয়ালের অ্যাটাক এখন ভঙ্গুর। ভিনিসিয়ুস, অ্যাসেন্সিও, রদ্রিগো; তারুণ্যে ভরা আক্রমণভাগের নেতা তিনি। একাই ম্যাচের পর ম্যাচ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন রিয়ালকে। রামোসবিহীন রিয়ালের সত্যিকারের নেতা যেন তিনি। গতকাল যে গোল করলেন তাকে মৌসুমের অন্যতম সেরা গোলের তালিকাতে স্থান পেলেও অবাক করার মতন কিছু হবে না।

মার্সেলোর ক্রস জমা পড়েছিল ক্যাসেসিমোর মাথায়, সেখান থেকে রদ্রিগোর মাথা ঘুরে যখন বেনজেমার সামনে এসে পড়ল, তখন উড়ন্ত বলে ভলি করে বল জড়িয়ে দিলেন চেলসির জালে। সকলে যেন হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিল সেই সৌন্দর্য্যে। জিনেদিন জিদানের যেন মনে পরে গিয়েছিল ২০০২ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের কথা। এমন এক ভলিতে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র গ্লাসগো।

এক ভলি যেন রেকর্ডের খাতা নিয়ে বসেছিল বেনজেমার সামনে, এক গোল দিয়েই রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন তিনি। চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার রালিকায় এখন ৪র্থ তিনি। ৭১তম গোল করে ছুঁয়েছেন আরেক রিয়াল মাদ্রিদ লিজেন্ড রাউল গঞ্জালেজকে। শুধু এটাই নয়, তার ৭১ গোলের মধ্যে নেই কোনো পেনাল্টি থেকে গোল। তার সামনে শুধু রোনালদো, মেসি আর লেওয়ান্ডস্কি।

রিয়ালের জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ফাইনালে সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে গোল করার রেকর্ডও এখন বেনজেমার কাছে। ৩৩ বছর বয়সে গোল করে ছাড়িয়ে গিয়েছেন মেসি-রোনালদো দুজনকেই। দুজনের শেষ সেমি ফাইনালে গোল ছিল নিজেদের ৩২ বছর বয়সে।

রিয়াল ছাড়ার পর থেকে রোনালদোকেও গোলের দিক থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন বেনজেমা। জুভেন্টাসের জার্সিতে ১৪ গোল করা রোনালদোর বিপরীতে ১৫ গোল নিয়ে এগিয়ে আছেন বেনজেমা।

বেনজেমার গোল আর দুই একটা অ্যাটাক বাদে জিনেদিন জিদানকে কোনো সুযোগই দেননি জার্মান কোচ। জিদানকে পুরপুরি ট্যাক্টিক্যালি আউটবিট করেছেন কান্তেকে দিয়ে। পগবা একবার বলেছিলেন, কান্তের নাকি ১৫টা ফুসফুস। সে চাইলে পুরো মাঠে ১৮০ মিনিট ধরে দৌড়াতে পারে।

সেটার নিদর্শনই দেখা গিয়েছে গতকাল, বিন্দুমাত্র সুযোগ পাননি কোনো রিয়ালের খেলোয়াড়, কান্তেতে বাক্সবন্দী হয়ে ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সেজন্য প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচের খেতাবটাও গিয়েছে তার পকেটেই। ১-১ গোলে মাঠ ছাড়া চেলসির জন্য প্লাস পয়েন্ট অ্যাওয়ে গোল, নিজেদের মাটিতে মাটি কামড়ে পরে থাকলেই ফাইনালে পা রাখবে তারা। টুখেলের জন্য এটা অবশ্য কঠিন কিছু নয়, রিয়ালের বিরুদ্ধে ৫ ম্যাচ খেলে এখনও হারের স্বাদ না পাওয়া (১ জয়, ৪ ড্র) টুখেল রিয়ালকে থামিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link