রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই। ঘরে ঘরে যুদ্ধ! হীন রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রে বিভক্তি। অযথা রক্তপাত।
এমন একটা পরিস্থিতি আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র আইভরি কোস্টের ভবিষ্যৎকে একটা সময় করে তুলেছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।
বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্র, জাতিসংঘ প্রমুখের আহ্বান, অনুরোধ যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত, তখনই ফুটবল, হ্যাঁ, ফুটবলই এক করে দিয়েছিল আইভরিয়ান জাতিকে।
ঘটনাটা খুলে বলি।
২০০৫ সাল, আফ্রিকান দেশগুলোর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা চলছে। সুদানকে হারিয়ে সেবার প্রথমবারের মতো আইভরিকোস্ট বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। পুরো দেশ তখন আনন্দে উদ্বেলিত।
কেনই বা হবে না? পাঁচ বছর ধরে দেশটি প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে পীড়িত। চারিদিকে ক্ষুধা, হত্যা, অত্যাচার আর রক্ত। এদিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার আনন্দে স্বভাবতই মত্ত খেলোয়াড়রা।
ড্রেসিংরুমে চলছিল উল্লাস। এরই মধ্যে দ্রগবা সবাইকে উল্লাস থামাতে বলেন। ডেকে আনা হয় মিডিয়াকে, পুরো আইভরিকোস্ট তখন টিভির সামনে সরাসরি সম্প্রচারে। মাইক্রোফোন হাতে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে দিদিয়ের দ্রগবা বিবাদমান দু’পক্ষের কাছে অনুরোধ জানালেন, ‘রক্তক্ষয় বন্ধ করুন, অস্ত্র নামিয়ে রাখুন, নির্বাচন দিন, আসুন দেশকে নবনির্মাণ করি!’
রূপকথার গল্প নয়, সত্যিই গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! সেই থেকে আইভরি কোস্টে দিদিয়ের দ্রগবা যেন এক ত্রাণকর্তা, দু:সময়ের বন্ধু।
তার জনপ্রিয়তা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে জানেন, চকলেট থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন—আইভরি কোস্টের বাজারজাতকৃত প্রায় প্রতিটি পণ্যের প্রসারেই ব্যবহৃত হয় এই ফুটবলারের ছবি!
দিদিয়ের দ্রগবা ছোটবেলায় খেতে পাননি, ঘুমানোর জায়গা পাননি, চোখের সামনে দেখেছেন রক্তের ছড়াছড়ি, সেই দ্রগবা হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার, আফ্রিকার সেরা খেলোয়াড়!
ভাবুন, চেলসির মত ক্লাবে খেলেছেন আফ্রিকার অজপাড়াগা থেকে উঠে আসা একটি ছেলে। সেই যুদ্ধবিরতির দুই বছর পর আবার দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা, লড়াই শুরু হতে থাকে।
আবার তিনি এগিয়ে এলেন, প্রেসিডেন্টকে বলে জাতীয় দলের একটি ম্যাচ রাজধানী থেকে বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে।
সে ম্যাচে আইভরি কোস্টের জাতীয় সঙ্গীতের সময় দুই নেতাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যখন জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন, তখন দ্রগবার কাছে মনে হচ্ছিল, যেন এক নতুন আইভরি কোস্ট জন্ম নিচ্ছে।
একজন সাংবাদিককে তিনি বলেছেন, ‘আমি অনেক ট্রফি জিতেছি, কিন্তু এদের কোনোটিই আমাকে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার চেয়ে বেশি মর্যাদা ও আনন্দ দেয়নি!’
একজন খেলোয়াড় যে তাঁর খেলোয়াড়ি সত্তার চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারেন, দিদিয়ের দ্রগবা বোধ হয় এর দারুণ এক উদাহরণ!