‘করুণ’ অধ্যায়

মায়ের দেহে পুরোপুরি পরিপক্ব হয়ে ওঠার আগেই পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। ফলে শ্বাসযন্ত্রে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছিল।

ডাক্তারের পরামর্শে সেই সমস্যা দূর করতে বাবা ভর্তি করে দিয়েছিলেন একটি ক্রিকেট ক্লাবে। তারপর ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের নানা ঘাট পেড়িয়ে নোঙর গেড়েছিলেন ভারতের জাতীয় দলে। ভারতের হয়ে খেলতে নেমেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলে রেকর্ড বইয়ের পাতা ওলট পালট করে ফেলেছিলেন। তবে সেই ঝড় হঠাৎই হয়ে গেলো নীরব। জাতীয় দলের বৃত্ত থেকে ছিটকে গেলেন করুণ নায়ার।

১৯৯১ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয়ার পর থেকেই শ্বাসযন্ত্রেই নানা সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর দুরন্ত শৈশবে প্রান ফিরে যখন ডাক্তার বললেন খেলাধুলায় মনোযোগ দিতে। বাবার হাত ধরে ১০ বছর বয়সে ভর্তি হলেন কোরামাঙ্গালা ক্রিকেট একাডেমিতে। রাজস্থানে জন্ম হলেও ইঞ্জিনিয়ার বাবার কর্মসূত্রে ২০০২ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে চলে যান করুণ নায়াররা। সেখানেই কোচ শিবান্দের তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে তাঁর ক্রিকেট শিক্ষা।

২০১৩-১৪ মৌসুমে কর্ণাটকের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। সেবছরই রঞ্জি ট্রফির শিরোপা জিতেছিল তাঁর দল কর্ণাটক। সেই মৌসুমেই রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল লিগ ম্যাচে টানা তিনটি সেঞ্চুরি করেন করুণ। পরের বছর আবারো শিরোপা জেতে তাঁর দল। সেখানেও ১০ ম্যাচে করেছিলেন ৭০৯ রান। তামিল নাড়ুর বিপক্ষে ফাইনলা ম্যাচে খেলেছিলেন ৩২৮ রানের এক ইনিংস। এটিই ছিল রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে কোনো ফাইনাল ম্যাচের একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি।

কর্ণাটকের হয়ে অসাধারণ দুই মৌসুম কাঁটিয়ে দ্রুতই সবার নজরে চলে আসেন। তখন থেকেই জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন আরো জোড়ালো হতে থাকে। তবে ২০১৬ সালে হঠাৎই এক নৌ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। সাঁতার না জানা করুণ নায়ারকে উদ্ধার করে স্থানীয় জনগন। তাঁর ঠিক চার মাস পরেই প্রথম বারের মত ভারতীয় দলে ডাক পান।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক ঘটলেও তেমন কিছু করে দেখাতে পারেননি। তারপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট দলেও ডাক পান এই ব্যাটসম্যান। তাঁর ছোটবেলার বন্ধু লোকেশ রাহুলের জায়গায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকও হয় তাঁর। প্রথম ম্যাচে চার রান করেই রান আউট হয়ে ফিরে যান। দ্বিতীয় ম্যাচেও রান পাননি করুণ। তাই চেন্নাইয়ে তৃতীয় টেস্টে দলে সুযোগ পাবেন কিনা তা নিয়েই ছিল দ্বিধা।

তবে আজিঙ্কা রাহানের ইনজুরির কারণে একাদশে জায়গা পান নায়ার। সেদিন চেন্নাইয়ে তাঁর খেলা দেখতে এসেছিলেন নায়ারের বাবা-মাও। ওই টেস্টেই রীতিমত তোলপাড় করে ফেলেন এই ব্যাটসম্যান। বন্ধু রাহুলের সাথে জুটি গড়ে হাঁটতে থাকেন বড় ইনিংসের দিকে। যেমনটা দুই বন্ধু খেলতেন কর্ণাটকের হয়ে। ১৯৯ রান করে রাহুল ফিরে গেলেই চলতে থাকে নায়ারের ব্যাটিং শো। পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।

সেই প্রথম সেঞ্চুরিকেই নিয়ে গিয়েছিলেন ডাবল, এমনকি ট্রিপল সেঞ্চুরিতেও। খেলেন ৩০৩ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। বিশ্বের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিকে নিয়ে গিয়েছেন ট্রিপল সেঞ্চুরিতে। তাছাড়া বীরেন্দ্র শেবাগের পর ভারতের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন নায়ার।

নিজের মাত্র তৃতীয় টেস্টেই ট্রিপল সেঞ্চুরি পাওয়া এই ব্যাটসম্যান স্বপ্ন দেখান নতুন এক ক্রিকেট তারকার। তবে সেই স্বপ্ন ও বাস্তবের পার্থক্য তীব্র হয়ে তাঁর পরের তিন টেস্ট ম্যাচে। সেই পাঁচ ইনিংসের একটিতেও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি নায়ার। তাছাড়া আজিঙ্কা রাহানে ইনজুরিতে থেকে ফিরে এলে দলে জায়গা হারান নায়ার। যদিও এখনো ৬ টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৬২.৩৩।

হয়তো সম্ভাবনাময় করুণ নায়ারকে আরো সুযোগ দিতেই পারতো ভারত। মায়ের পেটের মত ভারতীয় দলেও হয়তো পরিপক্ব হয়ে ওঠার পুরো সময়টা পেলেন না তিনি। কিংবা পরীক্ষিত আজিঙ্কা রাহানাকে ফিরিয়ে আনাই হয়তো অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল। যাইহোক,সেই আলোচনা তুলে রেখে নজর দেয়া যাক নায়ারের দল থেকে বাদ পড়ার পরের দিনগুলোর দিকে।

দল থেকে বাদ পড়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটেও যেন চেনা রূপ হারিয়ে ফেলেন তিনি। তবে ২০১৮-১৯ মৌসুমে কর্ণাটকের হয়ে আবারো রান পেতে শুরু করেন তিনি। রঞ্জি ট্রফিতেও করেছেন দারুণ পারফর্মেন্স। ২০২০ সালে ভারত লাল দলের হয়ে দীলিপ ট্রফিও খেলেন। এবারের আইপিএল নিলামেও বিক্রি হয়েছেন কলকাতার কাছে। সব মিলিয়ে করুণ নায়ার জানান দিচ্ছেন তিনি একেবারে হারিয়েও যাননি। তবে দলের যেই জায়গাটা তিনি হারিয়েছেন সেখানো এত ভিড় ঠেলে আবারো শক্ত করে নোঙর ফেলা যে সত্যিই বড় কঠিন।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link