তুমি নেই, ভরসা নেই

২০১৩ সালে বোর্ডের সাথে বকেয়া বেতন নিয়ে ঝামেলায় খেলা থেকে সরে দাঁড়ানোর চিন্তা করেন উইলিয়ামস। অবশ্য পরবর্তীতে বোর্ডের সাথে সমঝোতায় আবার খেলায় ফেরেন তিনি। দীর্ঘ ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে চেষ্টা করেছেন ডুবতে থাকা জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে আবার দাঁড় করাতে। কিন্তু পারেননি সফল হতে! এর মাঝে করোনায় বায়ো বাবল সহ ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার নিয়েও অনিশ্চয়তা! সব মিলিয়ে একটা বিরতি নিয়েই নিলেন এই অলরাউন্ডার।

ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম এক ঝাঁক তারাকে নিয়েই নক্ষত্রমন্ডল। সেদিক থেকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে এক ঝাঁক তারকা ক্রিকেটার থাকলেও বর্তমানে যে গুটিকয়েক তারকা ক্রিকেটার আছেন তাদের তালিকা করলে উপরের দিকেই থাকবেন অলরাউন্ডার শন উইলিয়ামস।

বর্তমান জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল খুঁটি বলা চলে উইলিয়ামসকে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র‍্যান্ট ফ্লাওয়ার, হেনরি ওলোঙ্গা, পল স্ট্র্যাঙ, অ্যান্ডি ব্লিগনট, টাটেন্ডা টাইবুদের পর জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের দুর্দিনে দলের হাল ধরেছেন যারা, তাদের একজন হলেন শন উইলিয়ামস।

একের পর এক পরাজয়ের মাঝেও মিডল অর্ডারে দলের অন্যতম ভরসা ছিলেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট এখন ধ্বংসের মুখে প্রায়! নব্বইয়ের দশকে অমিত সম্ভাবনাময়ী এই দলটি এখন হারিয়ে যাবার পথে। দু’বছর আগেও ক্রিকেট বোর্ডের সিদ্ধান্তে দেশটির সরকার হস্তক্ষেপ করায় আইসিসি থেকে বিনিয়োগ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের। বেতন ভাতা নিয়েও ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিল চরম ক্ষোভ। মাসের পর মাস ক্রিকেটারদের বেতন বকেয়া! অবশ্য জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের যে আয় রোজগারও ছিল না। সব মিলিয়ে বেশ বাজে সময়ই পার করছিল দলটি।

এর মাঝে সব ঠিক হলেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করছিল ব্রেন্ডন টেলর, ক্রেইগ আরভিন, সিকান্দার রাজা, শন উইলিয়ামসের হাত ধরে। তবুও ক্রিকেটে সেই উন্নতির ছোঁয়াটা যেন পাচ্ছিলো না দলটি। ম্যাচের পর ম্যাচ হারার ফলে সফলতার পারদ যেন নিশ্চিহ্ন প্রায়।

এর মাঝেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সেই উজ্জ্বল খুঁটি – শন উইইলিয়ামস! বর্তমানে আয়ারল্যান্ড সফরে থাকা উইলিয়ামস আইরিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিদায় নিবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। মূলত ক্যারিয়ারে অনিশ্চয়তা আর বায়োবাবলে মানসিক বিষাদে অতিষ্ট হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও পাঁচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ থাকলেও ওয়ানডে খেলেই বিদায় নিবেন জিম্বাবুয়ের এই তারকা ক্রিকেটার।

আইরিশদের বিপক্ষে তাই নতুন অধিনায়ক হচ্ছেন ক্রেইগ আরভিন। গেল এক বছরে মোট পাঁচ বার অধিনায়ক পরিবর্তন করেছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। এর আগে গেল এক বছরে চামু চিবাবা, ব্রেন্ডন টেলর, সিকান্দার রাজা ছাড়াও অধিনায়কত্ব করেছেন শন উইলিয়ামস। তবুও জয় পাওয়া যেন এই দলের জন্য এখন সোনার হরিণ! অবশ্য উইলিয়ামস ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকবেনই না কেনো?

কোচ লালচাঁদ রাজপুতের অধীনে গেল তিন বছরে মোটে চারটি ওয়ানডে জয়লাভ করেছে জিম্বাবুয়ে। তাও সব গুলোই এসেছে আরব আমিরাতের বিপক্ষে। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও প্রাথমিক বাছাইপর্ব উৎরাতে পারেনি দলটি। এরপর ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্টস টেবিলে আছে একদম তলানিতে। ২০২৩ বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনাও তাই বেশ ক্ষীন!

তাই সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন উইলিয়ামস। যদিও তিনি বলেছেন, তিনি আবার ক্রিকেটে ফিরবেন! কিন্তু বয়সটাও যে ৩৫! ক্যারিয়ারের একদম শেষ দিকেই ছিলেন তিনি। আদৌ তিনি কবে ফিরবেন, নাকি আর ফিরবেন না! সেটি নিয়েও বেশ সন্দিহান। তবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এই দুর্দিনে এমন এক তারকার বিদায়ে দলটি যেন আরো এক ধাপ নিচে নেমে গেল!

২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬। বুলাওয়ের এক ক্রিকেট পরিবারে জন্ম নেন শন উইলিয়ামস। উইলিয়ামসের বাবা কলিন উইলিয়ামসও একজন ক্রিকেটার ছিলেন। সেই সাথে জাতীয় হকি দলের কোচ হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন কলিন। তিনি মাতাবিলিল্যান্ডের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেন। উইলিয়ামসের মা প্যাট্রিকা মকিলোপ জিম্বাবুয়ের হয়ে হকিতে ছিলেন গোল্ড মেডালিস্ট! উইলিয়ামসের ভাইও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছেন। তবে, বাবাকে অনুসরণ করেই ক্রিকেট বেছে নেন উইলিয়ামস।

২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ৩১.৪০ গড়ে ১৫৭ রান ও ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। এরপর সেখান থেকে ২০০৫ সালেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানেসবার্গে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি। পরের বছর ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জিম্বাবুয়েকে নেতৃত্ব দেন তিনি। সেখানে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে জিম্বাবুয়ে। এরপর ২০০৬ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে খুলনায় ওয়ানডে অভিষিক্ত হন উইলিয়ামস। ২০১১ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের দলে থাকলেও ইনজুরির কারণে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে যান তিনি। ২০১৩ সালে সাদা পোশাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষিক্ত হন তিনি।

জিম্বাবুয়ের এই অলরাউন্ডার ১৪ টেস্টে ৪১ গড়ে ১৩৪ রান করেছেন। ৪ সেঞ্চুরির সাথে আছে ৩ ফিফটি। ওয়ানডেতে ১৩৬ ম্যাচে ৪৫ গড়ে ৪ সেঞ্চুরি ও ৩২ ফিফটিতে করেছেন প্রায় ৪ হাজার রান। এছাড়া ৪৭ টি-টোয়েন্টিতে প্রায় ১২৯ স্ট্রাইক রেটে ১ হাজারের কাছাকাছি রান করেছেন তিনি। বল হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উইকেট নিয়েছেন ১২৫টি!

স্পিনারদের বিপক্ষে বেশ দুর্দান্ত খেলতেন এই জিম্বাবুইয়ান অলরাউন্ডার। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় এক সাক্ষাৎকারে উইলিয়ামস জানান স্পিন ভালো খেলার পেছনের গল্পটা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সবসময়ই সৌরভ গাঙ্গুলির ব্যাটিং দেখতাম, তিনি যেভাবে দারুণভাবে স্পিন সামলাতেন। আমি পায়ের মুভমেন্ট ঠিকমতো করতে পারি, যার কারণে আমি সহজেই যেদিকে আমি চাই সেদিকেই মারতে পারি।’

২০১৩ সালে বোর্ডের সাথে বকেয়া বেতন নিয়ে ঝামেলায় খেলা থেকে সরে দাঁড়ানানোর চিন্তা করেন উইলিয়ামস। অবশ্য পরবর্তীতে বোর্ডের সাথে সমঝোতায় আবার খেলায় ফেরেন তিনি। দীর্ঘ ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে চেষ্টা করেছে ডুবতে থাকা জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে আবার দাঁড় করাতে। কিন্তু পারেননি সফল হতে! এর মাঝে করোনায় বায়োবাবল সহ ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার নিয়েও অনিশ্চয়তা! সব মিলিয়ে একটা বিরতি নিয়েই নিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।

হয়তো ফিরবেন। নয়তো এখানেই ক্যারিয়ারের শেষটা লিখে যাবেন এই জিম্বাবুইয়ান তারকা! দিয়েছেন নিজের সামর্থ্যের সবটুকুই। কিন্তু প্রাপ্তির অংশ যে অতি সামান্যই!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...