বিষাক্ত কোবরার ছোবল

কিউই পাখির দেশ নিউজিল্যান্ডে সেবার টেস্ট খেলতে গিয়েছে ভারত।

সালটা ১৯৭৬। সেই ম্যাচে আম্পায়ররা নিউজিল্যান্ডকে হোম অ্যাডভান্টেজ দিয়ে যাচ্ছিল খুবই দৃষ্টিকটু ভাবে। এমনকি পরিষ্কার এলবিডব্লু কিংবা ব্যাট-প্যাডের ক্যাচ গুলোও আউট দেয়া হচ্ছিল না। সেই সময় চাপা জেদ নিয়ে বল করতে এলেন তিনি। কিউই ব্যাটসম্যান কেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেললেন। তবুও ক্ষোভ দেখাতে আম্পায়ারের কাছে আউটের আপিল করতে লাগলেন তিনি।

আম্পায়ার বলেন, ‘হ্যাঁ, ও তো বোল্ড হয়েছে।’ উত্তরে সেই বোলার বলেছিলন, ‘জানি বোল্ড হয়েছে, আউট কি হয়েছে?’

তিনি উত্তর দিতে জানতেন মাঠে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের, তিনি জবাব দিয়েছিলেন ছোটবেলার মারণব্যাধিকে এবং সর্বোপরি তিনি উত্তর দিয়েছেন জীবনকে। এই উত্তর দিতে পারার অভ্যাসটাই তাঁকে ভারতের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসনে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি ভগবত সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর।

ছোটবেলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন মরণব্যাধি পোলিওতে। তিন মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দেখেছেন কিভাবে কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছিল তাঁর ডান হাতটি। তবে সেই শুকিয়ে যাওয়া ডান হাত দিয়েই যে তিনি একদিন বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানকে মাঠে নামার আগেই আউট করার ঘোষণা দিবেন তা কে জানতো।

১৯৭৯ সালে ক্রিকেট বিশ্বের ব্যাটসম্যানশিপের সংজ্ঞা তখন ভিভ রিচার্ডস। সেই বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান ভারতের বিপক্ষে এক প্রস্তুতি ম্যাচে মাঠ নামছেন। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানো রিচার্ডসে সেদিন ভারতীয় এক লেগ স্পিনার বলেছিল, ‘ওহে আমার প্রিয় খাদক, স্বাগতম।’

বিশ্বকাপানো ব্যাটসম্যান সেদিন কোনো জবাব দেননি আদতে দিতে পারেননি। সেদিন তো বটেই , আরো পাঁচ বছর আগে যেদিন ভিভ রিচার্ডসের অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে সেই টেস্টে পরপর দুইবার এই লেগির ফাঁদে পা দেন ভিভ রিচার্ডস। অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসে ফিরেছেলেন যথাক্রমে তিন ও চার রানে। হ্যাঁ, তিনিই সেই পোলিও আক্রান্ত, শুকিয়ে যাওয়া ডান হাতের লেগ স্পিনার ভগবত চন্দ্রশেখর।

ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম এবং সেই সময়ের সবচেয়ে বড় ম্যাচ উইনার ছিলেন চন্দ্রশেখর। ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয় পায় ভারত। সেই ম্যাচের সবচেয়ে বড় পারফর্মার ছিলেন তিনিই। ৩৮ রানে ৬ উইকেট নিয়ে লিখেছিলেন প্রথম ইংল্যান্ড জয়ের কাব্য। বছর দুয়েক পরে ইংল্যান্ড খেলতে আসে ভারতে।

কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে সেই ম্যাচ জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের দরকার মাত্র ১৯২ রান। তবে চতুর্থ দিন শেষবেলায় বেদির বোলিং ঘুর্নিতে ১৭ রানেই চার উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। তবে পঞ্চম দিন সকালে টনি গ্রেগ ও মাইক ডেনেস মিলে ৯৭ রান যোগ করলে আবারো সহজ জয়ের দিকে এগোতে থাকে ইংল্যান্ড। সেই সময় বোলিং এ এলেন দ্য ম্যাচ উইনার চন্দ্রশেখর। বোলিং এর জন্য একটু লম্বা রান আপ নেন তিনি। তাঁর রান আপের প্রতিটা পদক্ষেপে কলকাতার ইডেনে এক গর্জন উঠে, ‘চন্দ্র..চন্দ্র..চন্দ্র.. ।’

সেই গর্জন, সেই উল্লাসে মাথা নত করেছিল তখনকার অপরাজেয় ইংল্যান্ডও। চন্দ্রশেখরের গুগলিতে দিশেহারা হয়ে ১৬৩ রানেই অল আউট হয় ইংল্যান্ড। তিনি কত বড় ম্যাচ উইনার ছিলেন পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর একটু প্রমান দেয়া যাক। মোট ৫৮ টেস্ট খেলে ২৯.৭৪ বোলিং গড়ে তিনি ২৪২ উইকেটের মালিক।

তবে তাঁর খেলা যেই ১৪টি ম্যাচে ভারত জয় পেয়েছে সেখানে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৯৮ টি। ওই ১৪ ম্যাচে তাঁর বোলিং গড় ১৯.২৭। তাঁর পুরো ক্যারিয়ারে ৫ উইকেট নিয়েছেন মোট ১৬ বার। আর ভারতকে জয় এনে দেয়া সেই ১৪ ম্যাচেই ৫ উইকেট নিয়েছেন ৮ বার। ক্যারিয়ারে দুইবার ১০ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে এই লেগির। সবমিলিয়ে সেই সময়ে ভারতের ক্রিকেটে তাঁর চেয়ে বড় ম্যাচ উইনার আর কেউ ছিল না।

চন্দ্রশেখরের সবচেয়ে বড় শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা ছিল একটিই। সেটি ছিল পোলিওতে শুকিয়ে যাওয়া তাঁর ডান হাত। একবার একজন তাঁর হাত প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওখানে আসলে কোনো মাংসপেশি ছিল না, শুধু হাড্ডিটাকে একটা চামড়া দিয়ে ঢাকা।’

সেই দুর্বলতাকেও তিনি তাঁর শক্তির জায়গায় পরিণত করেছিলেন। সেই শক্তি এতটাই তীব্র ছিল যে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব ,মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। মৃত্যুকে জয় করা চন্দ্রশেখর জয় করেছিলেন ভারতের মানুষের অবাধ ভালবাসাও। তাইতো এখনো আমরা নিঃসন্দেহে লিখতে পারি ভারতের স্পিন বোলিং এর মহানায়ক ছিলেন ভগবত চন্দ্রশেখর।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link