বাস্তব জীবন কখনো কখনো হার মানায় পর্দার রোমাঞ্চ, ট্রাজেডি কিংবা থ্রিলারকে। লুক পর্মাসব্যাচের ভাগ্য হয়ত তেমনি করেই বিধাতা গড়েছেন সবচেয়ে করুণ ছাঁচে। খেলা দেখতে গিয়ে হুট করেই নিজ দেশের হয়ে মাঠে নেমে যাওয়া থেকে স্কুটার চুরির দায়ে জেল। এক জীবনে যত অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটানো সম্ভব তা নিজের ৪০ বছরের জীবনে সবটাই করে ফেলেছেন তিনি ইতোমধ্যেই।
টিভিতে বা স্টেডিয়ামে খেলা দেখার সময় ব্যাট, বল হাতে অসম্ভব সব ম্যাচ বের করে আনার মনোবাসনা আমাদের সবারই থাকে, তাই না! অদ্ভুত দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে ভাবি, এই বুঝি ডাক এলো। মাঠে নেমে সবাইকে চমকে আমিই হয়ে যাব মহানায়ক, চারিদিকে হবে আমার নামে কলরব।
ঠিক এমনটাই যেন বাস্তব করতে পেরেছিলেন লুক। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন বান্ধবীর সাথে। ম্যাচ শুরুর মিনিট চল্লিশেক আগে জানতে পারলেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক হচ্ছে তার। অদ্ভুতড়ে লাগছে তাই না? লুকের ও লেগেছিল, তিনি ভেবেছিলেন কেও হয়ত মজা করছেন। তবে শুনতে সিনেম্যাটিক লাগলেও বাস্তবে আসলেই তা হয়েছিল।
সময়টা ২০০৭ সাল, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটিয়েছেন লুক। বয়সটা সবে ২৩, মনে বেশ প্রফুল্লতা। ভাবলেন যাই প্রিয় বন্ধু শন মার্শের সাথে একটু মদ্যপান করবেন। তবে বিধিবাম, গলাটা একটু বেশিই ভিজিয়ে ফেলেছিলেন তারা। ফলাফল! দুইজনই নিষিদ্ধ হলেন ১৪ ডিসেম্বর অবধি। অবসর সময়টা তাই ঘুরে ফিরে কাটাচ্ছিলেন লুক।
তবে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্টে’ বড় মোড় নিল লুকের জীবন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগ মূহুর্তে ইনজুরিতে ছিটকে গেলেন ব্যাড হজ। অস্ট্রেলিয়ার তখন একজন ব্যাটার দরকার। কেননা পাঁচ ব্যাটার, আর ছয় বোলার খেলানোর রিস্ক নিবে না অজিরা। কে যেন সিলেক্টরদের খবর দিল মাঠেই আছে লুক।
ডাক পড়লো তাঁর, দৌড়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে দেখলেন প্রাংক না। অস্ট্রেলিয়া চ্যায়েরম্যান একাদশের হয়ে প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৫ বলে খেলেছিলেন ৮৮ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। এতেই এমন অযাচিতভাবেই খুলে গেছে জাতীয় দলের দুয়ার।
রাজ্য দলে বহিষ্কৃত খেলোয়াড় কিনা খেলতে নেমে গেল জাতীয় দলে! কিন্তু কিট পাবেন কোথায়? পরে অন্যদের থেকে গ্লাভস, প্যাড, জুতো ধার করে মাঠে নামলেন তিনি। গায়ের জার্সিটাতে লেখা ‘ডি’বল’। আরেহ, এটা তো হজের ডাক নাম, ডজবল। তবে কি ইনজুরির খবরটা মিথ্যা!
সবার কৌতূহল দূর হল যখন লুক বা হাতে প্রথম বলটা মোকাবিলা করলেন। আসলে এত দ্রুত সময়ে তো আর জার্সি প্রস্তুত করা সম্ভব না। অগত্যা তাই হজের জার্সি পড়েই মাঠে নামতে হল তাকে। ব্যাটটাও বেশ ভালোই চালালেন তিনি। সাত বলে এক চার আর এক ছক্কায় করলেন ১৫ রান। হায় বেচারা লুক, তখন ও কি জানতেন জীবনে আর কখনোই নিজের নাম খচিত জার্সি পড়ে খেলা হবে না তার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে?
লুকের জীবনের গ্রাফটা যেন মৃত্যুশয্যায় পড়ন্ত বৃদ্ধের হার্টবিটের মতই। একবারে শিখরে উঠে, একদম জমিনে। এতটাই নিচে যা আর উঠবে না কখনোই। আহারে কি ঈষনীয় শিখরেই না উঠেছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে জিতেছিলেন ‘ব্র্যাডম্যান ইয়াং প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার। ২০০৮ থেকে ২০১২ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ও বিগব্যাশে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। একদম পিউর হিটার বলতে যা বুঝায় লুক ছিলেন তার অপর নাম। তবে সেই আইপিএল খেলতে গিয়েও বির্তকিত হয়েছিলেন তিনি। হোটেলে এক তরুণীর শ্লীলতাহানি চেষ্টা থেকে নিজের বাগদত্তাকে হেনস্তা কিছুই বাদ রাখেনি তিনি।
এর আগে হিট এন্ড রান কেসে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ অফিসারের গায়ে হাত তোলা থেকে, চুরি কিংবা আইনি হেফাজত থেকে পালানো সবই করেছেন লুক একজীবনে। এতকিছুর পরেও ক্রিকেটে তার প্রতিভার ধার কমেনি একটুও। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও ব্রিসবেন হিটের হয়ে খেলেছিলেন ৩০ বলে ৬৪ রানের ঝড়ো ইনিংস।
এরপরে চরম ভাবে বিষাদগ্রস্ত লুক, মানসিক সুস্থতার জন্য ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দেন। তার চিকিৎসার খরচ দিয়েছিল কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। বিয়েও করেন ২০১৫ সালে। স্ত্রী, কন্যা, সমুদ্র ভবন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রফুল্লচিত্তে ছুটে বেড়ানো দেখে সবাই ভেবেছিল হয়ত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন লুক।
কিন্তু বির্তকিত জীবনই যার নিয়তি সে আর পালাবে কোথায়? ড্রাগে আসক্ত লুক ২০২০ আসতে আসতে হয়ে পড়েন ভিটেমাটি-হীন। থাকা শুরু করেন নিজের গাড়িতেই। ২০২১ এসে তার নামে জামাকাপড়, সাইকেল, জুয়েলারি চুরির ও অভিযোগ উঠে। ২০২২ সালে বিদুৎচালিত সাইকেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন লুক। এখনো তিনি বিভিন্ন মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন কোর্টের দুয়ারে দুয়ারে।
লুকের কাহিনী তাই নাটককে ছাপিয়ে আরও বড় নাট্যমঞ্চের প্লট সাজিয়ে গেছে। যাতে লুক নিজেই নায়ক আবার নিজেই খলনায়ক। প্রতিভার কি নিদারুণ অপচয়!