আমার মনে হয় আমার জীবনে তিনটি বড় মৃহূর্ত এসেছে, যখন আমি প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম; আর হ্যাঁ, আমি স্নায়ুচাপে ভুগছিলাম। এর মাঝে দুটো বেশ অনুরূপ অনুভূতি।
দ্য ভয়েসের সরাসরি অডিশনে গান গাইতে যাবার ঘটনার আগে আমার মনে পড়ছে ১৯৯৫ সালের কথা। ১৮ বছর বয়সে আমার টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেকের দিনের কথা। হারারেতে ঐ দিন, আমি লম্বা শ্বাস নিয়ে বলটা করলাম এবং দেখলাম, বলটা বাজেভাবে লেগসাইডের বাইরে দিয়ে ওয়াইড হয়ে চার হয়ে গেল।
ভাগ্যিস আমি দ্রুতই ফিরে আসি, দুই বল পরেই একটা উইকেট পেয়ে যাই। আমার অধিনায়ক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ক্যাচটি ধরে। আমার অভিষেক ছিল ঘটনাবহুল। আমরা ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচ জিতি এবং এটা ছিল জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট জয়। প্রথম ওভারের মিশ্র অভিজ্ঞতার পর, আমি মাত্র দশ ওভার বল করেই ইনজুরিতে পড়ে মাঠের বাইরে চলে যাই।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না জাতীয় টিভিতে গান করতে যাবার সময় আমি উৎসাহী ছিলাম যেন আমার টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুর মতো না হয়। তবে এবারে আমি আরো অভিজ্ঞ, ৪২ বছরের একজন। যদি টেস্ট অভিষেক হয় একটি ঝড়, তবে দ্য ভয়েস সামান্য দমকা ঝড়ো হাওয়া।
প্রথম যে জিনিসটি আপনি অনুভব করবেন সেটা হলো জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা (সিডনি স্টুডিও পুরোপুরি শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত) এবং অন্ধকার। হালকা আলো-আঁধারিতে জায়গাটা টিভিতে চমৎকার দেখায়, তবে আপনি এখানে কিছুক্ষণ থাকলে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। তারপরও, আমি বেরিয়ে এলাম, দশ সেকেন্ডের মাঝে সবকিছু দেখে নিলাম। আরেকটা বড় শ্বাস নিলাম আর হারিয়ে গেলাম, আমার প্রিয় একটা গান গাইতে গাইতে, অ্যান্থনি ওয়ারলো’র ‘দিস ইজ দ্য মোমেন্ট’।
যদি আমি আমার গানকে ক্রিকেট বলের সাথে মেলাই, তাহলে এই ডেলিভারিটা ঠিকঠাক ছিল। দ্বিতীয় লাইনেই দর্শকরা উল্লাসধ্বনি দিতে শুরু করে, এটা আমাকে আরো উত্তেজিত করে দেয়। আর আনুমানিক ৩০ সেকেন্ডের সময় যখন প্রথম বিচারক হিসেবে ডেলটা গুডরেম ঘুরে তাকালেন, তখন আমি স্রেফ উড়ছিলাম। যখন আপনি একটি চেয়ার পেয়ে যাবেন (দ্য ভয়েসে চেয়ার পাওয়া মানে হল আপনি বাদ পড়ছেন নাহ) সেটা কিছুটা প্রথম উইকেট পাওয়ার অনুভূতির মতো। মানে হলো এখন আপনি রিল্যাক্স করতে পারেন।
তারপর বয় জর্জ ঘুরলেন, যার গান আমি ছোটবেলায় শুনতাম! এবং একেবারে শেষে কেলি রোল্যান্ড, যার দলে আমি যোগ দিয়েছিলাম।
এই দুইটি ঘটনার মাঝে কিছু মিল আবার কিছু অমিল আছে। ১৯৯৫ সালে, আমি মিডিয়ার সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ছিলাম জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ টেস্ট ক্রিকেটার, স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমের প্রচারের আলোয় ছিলাম এবং আমি সেটাতে অভ্যস্ত ছিলাম। তবে দ্য ভয়েসের জন্য আমি তেমন কেউকেটা নই! আমি এখন অ্যাডিলেডে থাকা একজন পিতা এবং আমার ক্রিকেট জীবন এখন প্রাচীন ইতিহাস।
অডিশনের জন্য আবেদন করতে আমার বেশ কয়েকজনের উৎসাহের প্রয়োজন হয়েছে। কারণ আমি তেমন কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। যেটা আমি তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে পেয়েছিলাম। নকআউট স্টেজে আসার পর আমার আত্নবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। দ্য ভয়েসে আমার উপস্থিতির পর আমি সারাবিশ্ব থেকে প্রচুর মেসেজ এবং টুইট পেয়েছি।
মানুষ হয়তো বুঝতে পারছে না, তবে গান গাওয়া আমার কাছে নতুন কিছু নয়। এমনকি আমার স্কুল জীবন শেষে আমি লন্ডন একাডেমি অব মিউজিক এন্ড ড্রামাটিক আর্ট থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। আমি ক্রিকেট বেছে নিয়েছিলাম কারণ আমার গানের শিক্ষক বলেছিলেন কোনো গায়কের কণ্ঠস্বরই ৪০ বছরের আগে স্থির হয় না। তাই আমি ক্রিকেটে যেতে পারি এবং অবসর নেবার পরে হয়তো গান গাইতেও পারি।
কিন্তু যা আমি জানতাম না তা হলো, আমার অবসর গ্রহণ আমার প্রত্যাশার চেয়ে তাড়াতাড়ি আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।
- কালো আর্মব্যান্ডের স্মৃতি
হাতে কালো আর্মব্যান্ড পরা ছিল আমার জীবনের তৃতীয় ঘটনা যেখানে আমি পুরোপুরি প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম।
টেস্ট অভিষেক এবং দ্য ভয়েস ছিল স্নায়ুচাপের, তবে আমি অন্তত জানতাম যে আমি বল করতে পারি এবং আমি গাইতে পারি। কিন্তু আপনি যখন কোনও স্বৈরশাসকের সামনে দাঁড়ান তখন কী আশা করতে পারেন? এটি ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা এবং পুরোপুরি অজানাতে ডুবে থাকা।
আমি অবশ্যই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সাথে দিনটি নিয়ে কথা বলি এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের জন্য কালো আর্মব্যান্ড পরে করে আমি জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্রের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এক বিবৃতি প্রকাশের পরে তার সাথে আমি আলাদা ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলেছিলাম।
জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে নামিবিয়ার বিপক্ষে আমাদের ম্যাচে আমাদের প্রতিবাদ বিশ্বজুড়ে শিরোনাম তৈরি করেছিল। কয়েকমাস পরে রবার্ট মুগাবে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ‘পুনর্নির্বাচিত’ হওয়ায় বিষয়টি পুনরায় সামনে এসেছিল। আবারও একটি নির্বাচন যেটিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।
এটি ছিল মুগাবে-অনুমোদিত আমাদের দেশে শ্বেতাঙ্গ খামারের হিংস্র আগ্রাসনের যুগে। বিশ্বকাপের এক সপ্তাহ আগে জিম্বাবুয়ের বিরোধী নেতা মরগান সোভানগাইরাই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
আমাদের প্রতিবাদ সম্পর্কে দুটি উদ্ভট কারণ ছিল। এমনকি আমি জিম্বাবুয়ের বিশ্বকাপ দলে থাকতে চাইনি। ২২ জন খেলোয়াড়ের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ২০০২ এর শেষদিকে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং আমি সেখান থেকে বাদ পড়েছিলাম। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কেনিয়ার বিপক্ষে ২৮ রানে ৬ উইকেট নেওয়ার পরেই আমাকে দলে যোগ দিতে বলা হয়েছিল।
এবং সত্য কথা বলতে গেলে, আমরা যখন আমাদের প্রতিবাদের জন্য একসাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনো পর্যন্ত আমি আর অ্যান্ডি কয়েকবছর যাবত চোখে চোখ রাখিনি। আমার এবং শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের মাঝে দূরত্ব ছিল এবং আমরা হতাশ ছিলাম।
তবুও বিশ্বকাপের প্রস্তুতি চলাকালীন সে আমার রুমে আড্ডা দিতে এসেছিলো। তাকে অন্য একজন বলেছিলো, ‘এই অবস্থায় আপনার বিশ্বকাপ খেলা উচিত নয়। যাতে মনে না হয় যে, জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। যদি আপনি খেলেন তবে আপনি আসলে সরকারকে সমর্থন করছেন।’
অ্যান্ডি একটি প্রতিবাদের কথা ভাবছিলো। আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি নিজেই সেগুলো নিয়ে কয়েকবছর যাবত চিন্তা করছি। আমি বহু বছর যাবত মুগাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন, তার বাড়াবাড়ি এবং দুর্নীতি এমন অনেক কিছুর সাথে লড়াই করে এসেছি।
মুগাবে যা করছিলেন তা ছিল কল্পনার অতীত। তাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা ছিল সময়ের দাবি। সত্যি কথা বলতে আমি যুবক বয়সে দুইবার মুগাবের সাথে দেখা করেছি এবং তখন আমার কাছে দেশের নেতার সাথে দেখা করা গর্বের ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। তবে বছরের পর বছর ধরে বিদেশ ভ্রমণ এবং ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে পারায় আমার চোখ খুলে গিয়েছিল। আমি এমন কিছু বিষয় পড়েছিলাম যা কখনোই জিম্বাবুয়ের কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি।
অ্যান্ডি এবং আমি এই আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেকের সাথে কথা বলেছিলাম। তারা আমাদের যে পরিণতি ঘটতে পারে তার একটি দীর্ঘ তালিকা করেছিল: আমাদের ক্যারিয়ার হারাতে পারি, নির্বাসিত হতে পারি এবং হ্যাঁ, মৃত্যুু।
মুগাবে শাসনামল ছিল নির্মম। তারা তাদের বিরোধীদের উপর নির্যাতন, অত্যাচার, দুর্ব্যবহার, মিথ্যা অভিযোগ এমনকি হত্যা করার জন্য পরিচিত ছিল। আমরা যেটা করছিলাম সেটা কোনো ছোট বিষয় ছিল না।
অ্যান্ডি চারজনের মধ্যে সিনিয়র কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে আমার কাছে এসেছিলো। সে পুরো দলকে নিয়ে ম্যাচটি বয়কট করার কথা ভাবছিলো। তবে আমি ভেবেছিলাম সমস্ত খেলোয়াড়কে একমত করতে পারা অসম্ভব। এটা সবার প্রতি অন্যায় হবে।
উদাহরণস্বরুপ আমাদের উইকেটকিপার টাটেন্ডা টাইবু ছিল ১৯ বছর বয়সী। এটা তার পুরো ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারতো। তাছাড়া সবসময় অভিযোগ পাওয়া যায় যে কিছু খেলোয়াড়কে জোর করা হয়েছিল।
ম্যাচ বর্জন কিংবা খেলতে অস্বীকৃতি জানানো অথবা দ্বিতীয় সারির দল খেলানো হয়তো পুরো টুর্নামেন্টকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতো স্বাগতিক হিসেবে জিম্বাবুয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে। কমপক্ষে একটি প্রতিবাদ যা পুরো ম্যাচজুড়ে দৃশ্যমান হবে, আশা করছিলাম খেলতে না চাওয়ার চাইতে সেটা বেশি শক্তিশালী হবে।
তাই আমার প্রস্তাব ছিল পুরো দলকে সম্পৃক্ত না করার। তারপর আমরা চিন্তা করলাম দুজন সিনিয়র শ্বেতাঙ্গ এবং দুজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের কথা এবং অবশেষে আমরা একমত হলাম যে কেবল আমরা দুজনেই কালো আর্মব্যান্ড পড়ে মাঠে নামবো।
এবং পরদিন সেটাই ঘটলো।
আমরা টসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম কারণ টসের পর আর দলে পরিবর্তন আনা যায় না। আমরা ইংরেজ সাংবাদিক জিওফ ডিনকে আমাদের বক্তব্যের কপি সবাইকে বিলি করতে দিয়েছিলাম। যেটা আমি আগের রাতেই আমার নিজের প্রিন্টারে প্রিন্ট করে রেখেছিলাম।
অ্যান্ডি দলের সবাইকে জানিয়েছিল আমরা কি করতে যাচ্ছি এবং আমাদের বক্তব্যের এক কপি ড্রেসিংরুমে রেখে দিয়েছিলাম যদি কেউ সেটা পড়তে চায় সেজন্য। কারোরই কোনো ধারণা ছিল না কি ঘটতে যাচ্ছে। আমার মনে হয় না আমাদের অস্ট্রেলিয়ান কোচ, জিএফ মার্শও খুব একটা খুশি হয়েছিলেন এ ঘটনায়। তিনি কেবল চাচ্ছিলেন আমরা যেন আমাদের পুরো মনোযোগটা কেবল মাঠের খেলাতেই রাখি।
অবশ্যই, কিছুটা হলেও সবার টনক নড়েছিল। আমরা প্রথমে ব্যাট করেছিলাম। অ্যান্ডি হাতে কালো আর্মব্যান্ড পরে ব্যাট করতে নেমে ৩৯ রান করেছিল। বারান্দায় আমার আর্মব্যান্ড পরা অবস্থায় ছবি তোলা হচ্ছিল। লাঞ্চের সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি ভিন্স হগ আসেন এবং আমাকে আর অ্যান্ডিকে প্যাভিলিয়নের নিচের রুমে আসতে বলেন। আমরা জানতাম আমাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের এই বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে হবে। তোমরা এটা অস্বীকার করবে। তোমরা এটা করতে পারো না।’
কোনো সন্দেহ নেই ভিন্স কেবল চাচ্ছিলেন ঝামেলামুক্ত বিশ্বকাপ শেষ করতে কিন্তু আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমি বললাম, ‘ভিন্স আমরা এটা করে ফেলেছি। আমরা এটা ফিরিয়ে নিচ্ছি না।’
আমরা লাঞ্চ শেষ করে মাঠে ফিরে গেলাম এবং পুরোটা সময় আমি আর অ্যান্ডি কালো আর্মব্যান্ড পরেই ফিল্ডিং করলাম। বৃষ্টিতে ম্যাচ দ্রুত শেষ হয়ে যাবার আগে আমি তিন ওভার বল করেছিলাম। ম্যাচটি আমরা খুব সহজেই জিতে গিয়েছিলাম।
পরের কয়েকদিনে খুব বেশি কিছু ঘটেনি। আমাকে আর অ্যান্ডিকে জেডসিইউ অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সেদিন সভাপতি আর মিডিয়া ম্যানেজার আমাদের উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিলেন। আমি নিশ্চিত তাদের উপর রাজনৈতিক চাপ দেয়া হয়েছিল। এর পরিণতিতে আমাকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল যদিও আমি স্কোয়াডে ছিলাম। অ্যান্ডিকে দলে নেয়া হয়েছিল কারণ বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়েরা জানিয়েছিলো অ্যান্ডিকে না নেয়া হলে তারা খেলবে না।
জেডসিইউ আমার উপর ক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। তাঁরা আমাদের বলেছিল কালো আর্মব্যান্ড না পরতে। আমি লাল আর্মব্যান্ড পরেছিলাম। তারা আমাকে সেটাও সরিয়ে নিতে বলেছিল। আমি মৃত্যুর হুমকি পেতে শুরু করি। সত্যিই এটি ছিল বেশ ভয়ঙ্কর সময়।
শেষ পর্যন্ত সম্ভবত আজ আমি বেঁচে থাকার কারণটি হল আবহাওয়া। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্ব, সুপার সিক্সস, যা পুরো দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হবে, আমাদের কোয়ালিফাই করার জন্য গ্রুপের শেষ খেলায় পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের প্রয়োজন ছিল। এমনকি ড্র করতে পারলেও আমরা কোয়ালিফাই করতে পারবো। যদি আমরা তা করতে পারি, তবেই কেবলমাত্র আমি জিম্বাবুয়ে থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো।
সেই স্বপ্নও ফ্যাকাশে হয়ে আসছিল যখন পাকিস্থান ১৪ ওভারে ৭৩ রান তুলে ফেলেছিল। আমাদের ম্যাচ জয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ পাকিস্থান দলে তখন ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতারদের মতো বোলার।
কিন্তু তখনি বৃষ্টি শুরু হলো এবং বৃষ্টি হতেই থাকলো। ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং কোনো রিজার্ভ ডে না থাকায় আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।আমরা সেখানে পৌঁছানোর পর জিম্বাবুয়েতে থাকা আমার বান্ধবী আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। এরপর আর আমার জিম্বাবুয়েতে ফিরে আসার কোনো কারণ ছিল না।
তবে তখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বাজে ঘটনা আরম্ভ হয়নি।
সুপার সিক্সে প্রথম দুটি ম্যাচই আমরা হেরে যাই। আমাদের শেষ দুটি ম্যাচ ছিল শ্রীলংকার বিপক্ষে, পোর্ট এলিজাবেথে। খেলা চলাকালীন আমরা খেয়াল করি যে ভিআইপি বক্সে জিম্বাবুয়ের পুলিশ অফিসারেরা বসে আছে। পরবর্তীতে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আমরা ধারণা করেছিলাম তারা হয়তো এখানে এসেছে আমাকে আর অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে জিম্বাবুয়েতে ধরে নিয়ে যেতে এবং সেখানে আমাদেরকে মেরে ফেলা হবে।
ম্যাচ শেষ হয়ে গেলে আমি দ্রুত একটি বিবৃতি প্রকাশ করি এই মর্মে যে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করছি এবং হ্যাঁ, আমি এখনো আমরা বক্তব্যকে সমর্থন করছি। টিম অফিশিয়ালরা আমাকে জানান যে আমি এখন আর টিম বাসে উঠতে পারবো না, যদিও অ্যান্ডি পারছিলো।
আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভাগ্যক্রমে আমি নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে পরবর্তীতে আমার হোটেলে ফিরি।
দলের সাথে জোহানেসবার্গ যাওয়ার আগের কয়েকদিন আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সেখান থেকেই আমি দলকে বিদায় জানাই এবং নির্বাসনে চলে যাই। দু:খের বিষয় কেবলমাত্র ডগলাস হুন্ডো এবং টাটেন্ডা টাইবু কেবলমাত্র আমাকে বিদায় জানিয়েছিল। আমি জোহানেসবার্গে থাকা আমার বন্ধুদেরকে বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিতে আসতে বলেছিলাম এবং আমি তাঁদের সাথেই মাসখানেক কাটাই। যদিও আমি চিন্তিত ছিলাম জিম্বাবুয়ে পুলিশ হয়তো আমাকে ধরতে আসবে।
অবশেষে, আমাকে লন্ডনে যাবার বিমানের টিকিট দিয়েছিলেন একজন অসাধারণ আমেরিকান ব্যক্তি যিনি আমার গল্প শুনেছেন এবং ভাগ্যক্রমে তিনি একটি এয়ারলাইন্সের মালিক ছিলেন। ইংল্যান্ডে, আমি টিভি ও রেডিওর ধারাভাষ্যকার কাজ করেছি এবং বিখ্যাত ক্রিকেট ক্লাব ল্যাশিংস আন্তর্জাতিক একাদশের হয়ে খেলেছি।
কয়েক বছর আগে ডেনিস লিলির সাথে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কাজ করার সময় আমি তারার রিড নামক অজি তরুণীর সাথে পরিচিত হই। আরো কয়েক বছর লন্ডনে থাকার পর ২০১৬ সালে আমরা অ্যাডিলেডে চলে আসি।
জিম্বাবুয়েতে এখন কিছু বিষয় বদলেছে। এটা দুঃখের ব্যাপার যে তারা এখন বিশ্বকাপে খেলছে না। মুগাবে চলে গেছে তবে আমি এখনো আশাবাদী নই। কারণ সে চলে গেছে মানে এই না যে পুরো সিস্টেম পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি আশা করি অধঃপতনের শেষ বিন্দুতে পৌঁছানোর আগেই দেশটি একটা ভালো সরকার পাবে। কিন্তু আমি সত্যিই জানি না জিম্বাবুয়ের ভবিষ্যৎ কি।
আমাদের প্রতিবাদের ব্যাপারে: এটি কিছু অর্জন করেছে? বিক্ষোভ হিসেবে এটা কতটা প্রভাব ফেলবে তা অনুমান করা খুব কঠিন, তবে আমি আশা করি এটি জিম্বাবুয়ের অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করেছে। এটি অবশ্যই বিশ্বমাধ্যমের শিরোনামে এসেছে এবং মানুষজনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে।
এটি কি জিম্বাবুয়ে পরিবর্তনের জন্য বর্হিঃবিশ্ব থেকে চাপ বাড়াতে সহায়তা করেছিল? ঠিক আছে, আর যাই হোক এটি অবশ্যই কারো ক্ষতি করে নি।
একজন ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমি যা জানি তা হলো আমি খুবই ভাগ্যবান যে বুলাওয়েতে সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল। নইলে আমার জীবন আজকের মতো কখনোই হতো না এমনকি আমার বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়তো।
আমি হয়তো ১৬ বছর যাবত জিম্বাবুয়ের বাইরে আছি, কিন্তু এখনো জিম্বাবুয়ে আমার হৃদয়ে আছে এবং জিম্বাবুয়ের প্রতি আমার ভালোবাসা-আবেগ অবর্ণনীয়। একটি দেশাত্নবোধক গান লিখে, অসাধারণ মানুষের সাথে বাস করে, অনিন্দ্যসুন্দর আবহাওয়ায় থেকে আমি এখনো নিজেকে জিম্বাবুইয়ান হিসেবে গর্বিত অনুভব করি যদিও আমার নাগরিকত্ব পরিবর্তিত হয়ে ব্রিটিশ হয়ে গেছে।
আমি জিম্বাবুয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ আমাকে আজকের এই মানুষে পরিণত করার জন্য এবং আমি আশা করি জিম্বাবুয়ে অবশ্যই তার সোনালি দিন ফিরে পাবে।
বর্তমান সময়ে একজন সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে আমি খুব খুশি। আমি সিনেমা বানাচ্ছি, ছবি আঁকছি, আমি মাছ ধরতে ভালোবাসি এবং নিজেকে দাতব্য সংস্থার নানা কাজে ব্যস্ত রাখছি।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমি আট এবং ছয় বছর বয়সী দুজন কন্যা সন্তানের পিতা। তারা মাঝেমধ্যেই আমাকে গান বন্ধ করে দিতে বলে থাকে। কিন্তু দ্য ভয়েসে আমার অংশগ্রহণের পরে তারা আমার মতো গান গাইতে চায়। আমি আশা করি আমি তাদেরকে গর্বিত করতে পারবো।
– প্লেয়ার্স ভয়েস অবলম্বনে