৩১ আগস্ট, ১৯৬৮।
সোয়ানসির সেন্ট হেলেন মাঠে নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে টস জিতেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স, প্রতিপক্ষ সেদিন গ্ল্যামারগন। গ্যারি সোবার্সকে চেনেন তো! ওই যে যাকে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ‘ফাইভ ইন ওয়ান’ বলে ডাকতেন! ফাইভ ইন ওয়ানই বা কেন? এমন প্রশ্ন যদি মনে উদয় হয়, তাহলে চলুন উত্তরের কিছু অংশের খোঁজে ঘুরে আসি সেই কাউন্টি ম্যাচ থেকে!
গ্ল্যামারগনের হোম গ্রাউন্ড, সেকেন্ড ইন পয়েন্ট টেবিল! এমতবস্থায় নটিংহ্যামশায়ারের পরিস্থিতি বেশ নাজুক। টেবিলের পঞ্চমে থেকে জয় বিকল্প কিছু ভাবাই বৃথা! কথিত আছে, অধিনায়ক সোবার্স নাকি জয়ের ব্যাপারে এতটাই চার্জড ছিলেন যে, পুরো এক কেস শ্যাম্পেন বাজি ধরেছিলেন!
টসে জিতে ব্যাট করা নটিংহ্যামশায়ারের স্কোর চা বিরতির পর ৩০৮/৫! ক্রিজে এলেন গ্যারি, পরিকল্পনা তখন দ্রুত রান তুলে ইনিংস ঘোষণার! কত দ্রুত?
দ্রুততার গল্প মাত্র একটি ওভারের! একটি ওভার, যা কিনা গত চার যুগ ধরে আলোচিত, যা কিনা আগামী চারশো যুগের আলোচনার খোড়াক!
ম্যালকম ন্যাশ, যিনি কিনা গ্ল্যামারগনের ওপেনিং পেস বোলার, তিনি দলীয় ক্যাপ্টেন লুইসের পরামর্শে হঠাৎই হয়ে গেলেন বাঁহাতি অফস্পিনার! কিন্তু কেন? কোন ব্যাখ্যাই হয়ত পছন্দ হবে না, তাই বলে দেয়া ভালো, নিয়তি চেয়েছিল।
লেগ সাইডে শর্ট বাউন্ডারি, সামনে হঠাৎ করেই স্পিনার হয়ে ওঠা আনকোরা অর্থোডক্স, সাথে রান তোলার তাগাদা! গ্যারির জন্য সেকেন্ড ইনভাইটেশনের প্রয়োজন ছিল কি? থাকলেও সেদিন কি আর গ্যারি অপেক্ষা করতেন।
ম্যাচের পর ইন্টারভিউতে ন্যাশ বলেছিলেন, ‘অধিনায়ক এসে আমাকে বলল আমি কি একটু স্লো স্পিন ট্রাই করতে চাই কিনা। আমি শুরু করলাম, এবং সোবার্স খুব দ্রুতই শেষ করলো। ভেরি শর্ট এক্সপেরিমেন্ট ইনডিড!’
প্রথম বলটা গায়ের জোরে মিড উইকেটের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে! দ্বিতীয়টার গন্তব্যও একই দিকে তবে এবার গ্যালারিতে! কয়েকজন ওয়েলশম্যান তো বলটা নিয়ে লোফালুফিই শুরু করে দিল। তৃতীয় বলটা ন্যাশ করলেন অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরে, কিন্তু গ্যারি এবার গায়ের সব শক্তি একত্র করে চালালেন মিড অফের উপর দিয়ে, এতটাই পাওয়ার আনলিশ করলেন যে, ডান পা শুন্যে উঠে গেল। তিন বলে তিন ছয়!
এই পরিস্থিতিতে বোলার ন্যাশের কাছে আসলেন অধিনায়ক লুইস। বললেন, ‘তুমি যদি চাও তাহলে তোমার স্বাভাবিক স্টাইলে ফিরে যেতে পার, আমার কিন্তু কোন আপত্তি নেই!’
নিয়তি ন্যাশকে দিয়ে বলিয়ে নিল, ‘আই ক্যান হ্যান্ডেল ইট ক্যাপ্টেন, লিভ ইট টু মি।’
চতুর্থ বলটা বেশ জোরের সাথে সোজাসুজি করলেন ন্যাশ, গ্যারির পুল স্কোয়ার লেগে! টেরেসের সাথে বাড়ি খেয়ে মাঠের লেগ আম্পায়ারের কাছে এসে পড়ল লাল চেরিটা! গ্যালারিতে তখক্ষনে শুধুই ছয় ছয় ছয় বলে স্লোগান উঠে গেছে!
পঞ্চম বলটা হাফ ভলি, সোবার্সের লফটেট স্ট্রেইট ড্রাইভ, কিন্তু টাইমিংয়ে গড়মিল! রজার ডেভিস তখন লং অফ থেকে ছুটছেন, ডাইভ দিয়ে ধরে ফেললেন ক্যাচ! কিন্তু বিধিবাম! বাউন্ডারি লাইন পার করে ফেলেছে দেহটা। এদিকে সোবার্স ততক্ষণে প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা শুরু করেছেন!
নতুন আইনে ছক্কা, পুরাতন আইনে আউট। আবহের মায়ায় সেটা ভুলতে বসেছে সকলেই, কিন্তু আম্পায়ার সোবার্সকে থামালেন! ছক্কার সংকেতের সাথে সাথেই গ্যালারিতে আবারও গর্জন! ইতিহাসের অংশ হতে পারার রোমাঞ্চে তখন গ্যালারিও উন্মুখ।
ক্যাপ্টেন লুইস প্রায় সকল ফিল্ডারকে বাউন্ডারি লাইনে প্লেস করে দিলেন। ন্যাশের প্ল্যান ছিল সিম আপ ডেলিভারিতে ইয়োর্কার করানো, ‘আমি সিম আপ ফাস্ট ইয়োর্কার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রান আপ বদলাইনি, যেটা ছিল চরম ভুল! সম্ভবত এই একটি বলই আমি সেদিন করেছিলাম যেটা ছক্কা হবার যোগ্য।’
হাফ ট্র্যাকার বলটাকে মিড উইকেট দিয়ে একেবারে স্টেডিয়ামের বাইরেই পাঠিয়ে দিলেন গ্যারি! বাইরের রাস্তায় গড়াতে গড়াতে লোকচক্ষুর অন্তরালে। চর্চিত হবার জন্য ইতিহাস ততক্ষণে তৈরি।
পরের দিন কোন এক বিশাল মনের স্কুলবালক বলটিকে ফেরত দিয়ে গেলেন, ট্রেন্টব্রিজ ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মিউজিয়ামে বলটি এখনও আছে গায়ে বিখ্যাত কিছু ক্ষত নিয়ে।
ম্যাচটি নটিংহ্যামশায়ার জিতে নেয় ১৬৬ রানে। বাজিতে জেতা এক কেস শ্যাম্পেন উৎসবের গভীরতা কতটা বাড়িয়েছিল সেটা আজও জানা যায়নি।
পরবর্তী বছরগুলোতে ন্যাশ এবং সোবার্স খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে ওঠেন। অসংখ্য ইন্টারভিউ, অসংখ্যবার স্মৃতিচারন শুধু ওই একটা ওভারের! ন্যাশ পরবর্তীতে তার ক্যারিয়ারে সাকসেসফুল বোলার হিসেবেই পরিচিত হতে থাকেন। তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির খুব কাছে তিনি আরও একবার পৌঁছে গিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে! ফ্র্যাংক হায়েস সেদিন ন্যাশের ওভারে ‘৬ ৪ ৬ ৬ ৬ ৬’ – এভাবেই তাণ্ডব চালান।
নিয়তির তাসে শুধু ন্যাশের ছবিই ভেসে ওঠে যেন! ২৫ গড়ে ৯৯৩ প্রথম শ্রেনীর উইকেট শিকারে শেষ হয় ন্যাশের ক্যারিয়ার। ন্যাশ অবশ্য প্রতিশোধের খুব কাছাকাছিই গিয়েছিলেন একবার! জোয়েল গার্নার, ইয়ান বোথামদের নিয়ে গড়া সমারসেটের বিরুদ্ধে এক ওভারে চারটি ছক্কাও হাঁকিয়ে বসেছিলেন! ন্যাশের কিন্তু দু’টি সেঞ্চুরিও আছে ক্যারিয়ারে!
ইতিহাসকে সব থেকে সুন্দর সিটে বসে দেখেছে কে বলুন তো?
ভাগ্যবানের নাম জন পারকিন। ম্যাসাকারটা মাত্র বাইশ গজ দুর থেকে দেখে ধন্য হয়েছিলেন! বাইশ গজ কেন? কারণ, সেদিন নন স্ট্রাইকিং এন্ডে সোবার্সের পার্টনার ছিলেন এই জন পারকিন। এমনকি ক্যারিয়ার শেষে ব্রিক লেয়ারিংয়ের কাজ করার সময়ও তাঁকে গল্পটা বলতে হত! তাঁর থেকে ভালো বিবরন আর কেই বা দিতে পারতো!
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। ম্যালকম ন্যাশ ইহজগত ত্যাগ করেছেন! ৮৪ বছরের গ্যারি রয়ে গেছেন স্মৃতির সাক্ষী হয়ে! সময় বয়ে যাচ্ছে, ক্রিকেট বদলেছে, রবি শাস্ত্রীর পর যুবরাজ, গিবসরাও গ্যারির কীর্তির পুনরাবৃত্তি করে ফেলেছেন। ক্রিকেটে এখন টি-টোয়েন্টির যুগ। এখন প্রায়ই ছয় বলে ছয় ছক্কা হয়। তবুও কেউ কি গ্যারি হতে পেরেছেন? অথবা ম্যালকম ন্যাশ?