শীতের সকাল।
কুয়াশায় মোড়ানো মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের এ পার থেকে ও পার দেখা যায় না। কী এক খবরের সন্ধানে আমরা হাজির হয়েছি সাত সকালে।
তখনও স্টেডিয়াম মার্কেট জেগে ওঠেনি, তখনও ক্রিকেট বোর্ডের অফিস সরগরম হয়ে ওঠেনি, তখনও কোনো খেলোয়াড়ের চিহ্ন নেই স্টেডিয়ামে। কেবল দু চার জন মাঠকর্মী আর নিরাপত্তাকর্মী ইতি উতি ঘুরছেন। এর ভেতরেই অ্যাকাডেমি মাঠে ব্যাট-বলের ঠক ঠক শব্দ শোনা যাচ্ছে; কে যেন ব্যাটিং নক করছেন।
একটু বিস্মিত হয়ে এক তরুণ সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কুয়াশার মধ্যে কে নেট করছে?’
অভিজ্ঞ সহকর্মীরা এক গাল হেসে উত্তর দিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমাদের মুশফিকুর রহিম।’
হ্যাঁ, তিনি মুশফিকুর রহিম। আমাদের মিস্টার ক্রিকেট। একেবারে চোখ বুজে বলা যায়, এই বঙ্গভূমের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট সাধক। বিশ্বাস করুন, মুশফিক কেবল একজন সাধারণ ক্রিকেটার নন। ক্রিকেট ব্যাপারটা তাঁর কাছে কেবল একটা খেলা নয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ক্রিকেট খেলাটা তার কাছে একটা সাধনা।
আর এই সাধনার ফলেই মুশফিক একজন মাঝারি ক্রিকেটার থেকে নিজেকে একজন গ্রেট করে তুলেছেন। একেবারেই মাঝের বেঞ্চের একজন ছাত্র থেকে নিরলস চেষ্টা আর পরিশ্রম দিয়ে মুশফিক আজ বিশ্বসেরাদের কাতারে চলে এসেছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন বলতে অনেকদিন ধরেই সাকিব আল হাসান; আরেকটু জোর করলে সেখানে তামিম ইকবালের নামটা যোগ হবে। আবেগ, সাফল্য, মিথ মিলিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে মাশরাফি বিন মুর্তজাও বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এইসব মহীরূহের অনেকটা আড়ালেই পড়ে যায় মুশফিকের এই গ্রেট হয়ে ওঠার যাত্রাটা।
মুশফিকের এই সাধারণ থেকে গ্রেট হয়ে ওঠার যাত্রাটা শুরু হয়েছিলো ২০০৫ সালের ঠিক আজকের দিনটাতে; ২৬ মে।
লর্ডসে কিশোর এক বিষ্ময় হয়ে টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন মুশফিকুর রহিম।
সেবারের ইংল্যান্ড সফরকারী বাংলাদেশ দলে অনেকটা পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো মুশফিককে। তখন দলের নিয়মিত কিপার-ব্যাটসম্যান ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট। কিন্তু অনুশীলন ম্যাচে দূরন্ত পারফরম করা মুশফিককে শেষ পর্যন্ত মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়।
শুরুতে মোটেও বিস্মিত করে দেওয়ার মত কিছু করতে পারেননি যুব দল থেকে উঠে আসা মুশফিকুর রহিম। যুব দলে থাকতে থেকেই অবশ্য তাকে নিয়ে প্রত্যাশা ও হাইপের কম ছিলো না। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে বেশ সময় নেন মুশফিক।
২০০৫ সালে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট শুরু করা মুশফিক প্রথম টেস্ট ও ওয়ানডে ফিফটির দেখা পান ২০০৭ সালে; এর মধ্যে অবশ্য খুব বেশি ম্যাচ সুযোগ পাননি তিনি। ২০১০ সালে এসে প্রথম আর্ন্তজাতিক সেঞ্চুরির দেখা পান। পরের বছর ওয়ানডেতেও সেঞ্চুরিও পান। তারপরও মুশফিক খুব উজ্জল খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলেন, তা বলা যায় না।
২০০৭-০৮ সালের দিকে মুশফিকের জাতীয় দলে জায়গা নিয়েও নানা সময় প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ধীমান ঘোষ তাঁকে রিপ্লেস করে ফেলবেন, এমন একটা সম্ভাবনাও তৈরী হয়েছিলো। ধীমান আইসিএলে চলে না গেলে হয়তো মুশফিকের স্থায়ী হওয়াটাও কঠিন হতো।
ফলে মুশফিক একটা লাইফ লাইন পেলেন।
আর এটাই অসাধারণভাবে কাজে লাগালেন মুশফিক। ২০১১ সালের দিক থেকে মুশফিক আস্তে আস্তে নিজেকে বিশ্বমানে তুলে নেন। একেবারে সঠিক করে বললে, মুশফিকের পারফরম্যান্স বদলে যেতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে।
স্রেফ পরিসংখ্যানই আপনাকে এই ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাক্ষ্য দেবে। মুশফিকের ক্যারিয়ার ওয়ানডে গড় হলো ৩৭.১৮। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার ওয়ানডে গড় ছিলো ২৬-এর সামান্য বেশি। আর ২০১৪ সাল থেকে ওয়ানডেতে তিনি রান করছেন প্রায়র ৫০ গড়ে। গত বছর তিনে সেটা পঞ্চাশের অনেক ওপরে উঠে গেছে। টেস্টেও চিত্রটা প্রায় এক। ২০১৪ সাল থেকে তার গড় এক লাফে আগের সময়ের চেয়ে প্রায় ২০ বেড়ে গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুশফিকের এই দিনকে দিন আরও সফল হয়ে ওঠার রহস্য কী?
হয়তো মুশফিক টেকনিক্যাল কিছু জায়গা নিয়ে কাজ করেছেন। হয়তো নিজেকে আরেকটু এডজাস্ট করে নিয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে এসব কিছুই শেষ কথা মনে হয় না। মুশফিক আসলে আস্তে আস্তে এই সময়ে সাধনার একটা স্তরে উঠে গেছেন।
আমরা চোখের সামনে প্রতিদিন নেটে দেখেছি, একটা শট পারফেক্ট করার জন্য কী অসামান্য পরিশ্রম করছেন মুশফিক। ঘন্টার পর ঘন্টা এক ধরণের শট নিয়ে কাজ করে চলেছেন। যেখানে আমাদের ক্রিকেটারদের বাড়তি একটু পরিশ্রম করাটা বিরল একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, সেখানে মুশফিক কেবল নিজের আগ্রহে দিনের পর দিন এই পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। মুশফিককে এই অনুশীলনে আপনি একটু সময় অনুসরণ করুন, বুঝতে পারবেন, খেলাটায় রান করার কী অসীম ক্ষুধা নিয়ে ছুটছেন এই মানুষটা।
হ্যা, মুশফিকের কিপিং নিয়ে সমালোচনা আছে, মুশফিকের অধিনায়কত্ব যখন ছিলো, তা নিয়েও সমালোচনা করেছি। কিন্তু এই মানুষটার নিবেদন ও যোগ্যতা নিয়ে তার ঘোরতর শত্রুও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তার জীবনযাত্রাটা দেখলে আপনি একটা কথাই বলতে পারবেন, স্যালুট।