ফুটবল, পৃথিবীর সেরা প্রার্থণা সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের ঈশ্বর মেসি কিংবা পেলে। এতসব দেবতার ভীড়ে নটরাজকীয় শিল্পীর খেতাব জিতে নিয়েছিলেন একজন। যার প্রতিটি মুভমেন্টে লুকানো ছিল একেকটা সুর, একেকটা সংগ্রামের ঘ্রাণ, একেকটা জীবনের মানে।
তাঁর নাম জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান। তাঁর গল্পের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলে, মার্সেই শহরের ভাঙাচোরা রাস্তায়। আলজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে ভিটেমাটি হারানো স্মইল আর মালিকা যখন ফ্রান্সে এসে আশ্রয় নিলেন, তখনও জানতেন না যে তাঁদের অষ্টম সন্তানের পা দিয়ে ইউরোপের ফুটবল মানচিত্র বদলে যাবে।
ছেলেটার পায়ের নিচে প্রথম বলটা গড়িয়ে এসেছিল ধুলোর মাঠে, একটা ভাঙা বুটে। একটা সিগন্যাল ভাঙা সাইকেল, একটা হাফপ্যান্ট, আর একটা জীর্ণ ক্যানভাস বুট—এই ছিল জিজুর প্রথম কিট। কিন্তু মার্সেইয়ের রিফিউজি কলোনির ওই ৮০ বাই ১২ গজের গলিতে সে যখন বল পায়ে ঘুরত, মনে হতো যেন কোনো দ্যুতিময় গ্রিক মূর্তি মাটি ছেড়ে ভেসে আছে।
বন্ধুরা চুরি করত, জিজু খেলা শেখাতেন। বন্ধুরা ঘুমাত না ক্ষুধায়, জিজু নিজের প্লেট এগিয়ে দিত। ওই তো ছিল জিজু—একটা নি:শব্দ বিপ্লব। তাকে যেন স্বয়ং স্রষ্ঠা পাঠিয়েছিলেন সকল ক্ষুধার জবাব দিতে।
তাঁর খেলা মানেই ক্যানভাসে তুলি বুলিয়ে যাওয়া। তাঁর মুভমেন্ট মানেই কাব্য। কোনো কোচিং ম্যানুয়াল থেকে শেখা নয়, এগুলো জীবনের শোক, বঞ্চনা আর তীব্র ভালোবাসার রাসায়নিক মিশ্রণ। ফুটবল মাঠে তিনি ছিলেন এক ধ্যানমগ্ন নর্তক, যার কোমরের বাঁক দেখে মনে হতো — নটরাজের প্রলয় নৃত্য চলছে সবুজ গালিচায়।
১৯৯৮ সালে, যখন পুরো ফ্রান্স লম্বা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রাজিলের সামনে, তখন এক উদ্বাস্তুর ছেলে বিশ্বকাপ ফাইনালে দুটো হেড দিয়ে ব্রাজিলকে ফ্রেঞ্চ রংয়ে রাঙিয়ে দিল। জিদান ফ্রান্সকে জিতিয়েছে। এটাই চিরসত্যি।আসলে জিদান জিতিয়েছিলেন একটা দর্শনকে, একটা সমাজকে, একটা উদ্বাস্তু শিবিরকে।
২০০৬ সালে, বিশ্বকাপ ফাইনাল। বয়স তখন ৩৪। কে জানত, এটাই হবে ফুটবলের সবচেয়ে শুদ্ধ অথচ বেদনাময় অপেরা। মার্কো মাতেরাজ্জির কটূক্তির প্রতিউত্তরে এক ধাক্কা, এবং তারপর সবকিছু অন্ধকার। বিশ্বকাপ ট্রফির পাশ দিয়ে হেটে চলা একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।
যারা সারা জীবন আত্মসংবরণ করে বাঁচে, তাদের ধৈর্য একদিন ঠিক ফেটে পড়ে। হাজারো অপমানকে তিল তিল করে গিলে নিয়ে কেবল শিল্প সৃষ্টি করতেন যেখানে, সেখানেই একদিন এসে দাঁড়ায় ক্ষতের খোলস।
জিদান জানতেন—ফুটবলের সবচাইতে কঠিন শিক্ষা হলো ‘না বলা।’ না বলা নিজের ইগোকে, না বলা অতিরিক্ত চেষ্টাকে। তাঁর প্রতিটি মুভমেন্ট ছিল সংযমের নিদর্শন, যা কোনোদিন অতিরঞ্জিত হয়নি, বরং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে ভরা।
সেই জিদান বুট তুলে রেখেছেন, কোচিংয়ে সব জিতে নিয়ে আজ তেমন একটা আলোচনাতেও আসেন না। এর মধ্যেও তিনি হাজার হাজার দরিদ্র শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। ক্যান্সার পীড়িত শিশুদের জন্য মাঠে নামেন চ্যারিটি ম্যাচে। প্রচারের আলো থেকে বহু দূরে জিনেদিন জিদান এক বিশুদ্ধতার প্রতিমা। যার প্রতিটি বাঁক চোখে আঙুল দিয়ে শেখায়, এই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে ট্রফি না জিতলেও চলে!