কখনো ভেবেছেন নব্বই দশকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলা হলে কেমন হতো? কারাই বা রাজত্ব করত সে সময়টায়?- এমন প্রশ্নের একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছে খেলা ৭১। সেই সময়ের সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে একটা একাদশের চিত্র আঁকার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
নব্বই দশকের সেরা টি-টোয়েন্টি একাদশে জায়গা পেয়েছেন পাকিস্তানের চারজন, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের দুই জন করে চারজন। এছাড়াও শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের একজন করে জায়গা পেয়েছেন। চলুন দেখে নেওয়া যাক কেমন হয় সেই একাদশ।
- সনাথ জয়াসুরিয়া (শ্রীলঙ্কা)
আগ্রসনের প্রতিমূর্তি ছিলেন সনাথ জয়াসুরিয়া। নব্বই দশকের টি-টোয়েন্টি একাদশে তাকে ছাড়া অন্য কাওকে ভাবা প্রায় অসম্ভব। সেই দশকে তিনি ওয়ানডেতে রান তুলেছেন ৯০.৮৪ স্ট্রাইকরেটে। এখনকার যুগের সাথে সেই সময়ের ক্রিকেটের তফাৎ নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ৫০৮৩ রান করেছিলেন তিনি ১৮৭ ইনিংসে।
সাতটি সেঞ্চুরি ছাড়াও, ৩৩টি অর্ধশতক এসেছে তার ব্যাট থেকে। এই একাদশে স্থান পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি কি-না ১১১ খানা ছক্কা হাঁকিয়েছেন সেই আমলে। প্রতিকূল পরিবেশের বিপরীতে ঠিক কতটা আগ্রাসন দেখিয়েছেন জয়াসুরিয়া, তা অনুমান করে নেওয়াই যায়। তাছাড়া তার বোলিং দক্ষতাও তাকে এগিয়ে রেখেছে সবার থেকেই।
- অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (অস্ট্রেলিয়া)
সনাথ জয়াসুরিয়ার ওপেনিং পার্টনার হিসেবে জায়গা পাচ্ছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের আরেক ধারক। সেই সময়ে তার ব্যাট চলেছে ৮৭.৪১ স্ট্রাইকরেটে। ওয়ানডেতে স্রেফ ৭৪ ইনিংসে ২৩৭৬ রান করেছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।
আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেটের পেছনে তিনি বাজপাখির চাইতেও ছিলেন ক্ষিপ্র। একটা একাদশে তো উইকেটরক্ষকও প্রয়োজন। সে কারণেই অ্যাডাম গিলক্রিস্টের চাইতে এগিয়ে নেই কেউ। অজি এই কিংবদন্তিকে তাই ওপেনার হিসেবে তাকেই রাখা।
- ব্রায়ান লারা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা কতশত স্বপ্নবাজ তরুণের রোল মডেল। ব্যাট হাতে নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে ফেলেছিলেন লারা। স্রেফ নব্বই দশকে ওয়ানডেতে ৬১৬৬ রান করেছিলেন তিনি। তার স্ট্রাইকরেট ছিল ৭৯.৩০। তিন নম্বরে অ্যাংকর রোল পালনে তার থেকে সেরা বিকল্প আর হতেই পারে না।
লারা ১৩ খানা সেঞ্চুরি ও ৩৮ খানা হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন ক্যারিবিয়ান এই ব্যাটিং গ্রেট। ১৫৯ ইনিংসে তার গড় ছিল ৪২.৮১। এমন দারুন ধারাবাহিকতার কারণে তিনি সফলতার দেখা পেতে পারতেন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও। তাছাড়া তার দক্ষতা আর সামর্থ্য ছিল ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটেও নিজের ছড়ি ঘুরানোর।
- শচীন টেন্ডুলকার (ভারত)
নব্বইয়ের দশকে শচীন টেন্ডুলকার ছিলেন রীতিমত ব্যাটিং দানব। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সাল অবধি এই সময়ে সর্বাধিক রান করেছেন দ্য মাস্টার ব্লাস্টার। এমনকি ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ১১১টি ছক্কাও এসেছে তার ব্যাট থেকে। যতটা স্লথ তাকে মনে হয় তিনি কখনোই ছিলেন না ততটাও ধীরগতির।
সাদা বলে ২২১ ইনিংসে ৮৫৭১ রান করেছেন শচীন। ২৪টা সেঞ্চুরির সাথে ৪৪টি হাফসেঞ্চুরি করেছেন তিনি। তার স্ট্রাইকরেটও ছিল তার যথেষ্ট মানানসই। ৮৬.৮০ স্ট্রাইকরেটে চলেছে তার ব্যাট। অধিকাংশ সময়ে তিনি ওপেনিংয়ে ব্যাট করলেও, এই একাদশে তিনি চার নম্বরে ব্যাট করার জন্যে উপযুক্ত। তার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিধায়। স্রেফ স্ট্রাইকরেটে পিছিয়ে পড়ায় তাকে ওপেনিংয়ে ঠাই দেওয়া যায়নি।
- মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন (ভারত)
কিংবদন্তিদের এই একাদশকে নেতৃত্ব দেবেন ভারতের আলোচিত চরিত্র মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। নব্বইয়ের দশকে তিনি ভারত দলের অধিনায়ক ছিলেন। দলকে জয়ের পথে পরিচালিত করেছেন তিনি নিজে সামনে থেকে। একবিংশ শতাব্দীর ঠিক আগের দশকটিতে তিনি ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তুলেছেন। স্রেফ শচীন রয়েছেন তার উপরে।
২০৯ ইনিংসে ৬৮৫৮ রান করেছেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। এমন রানের ধারা তিনি টি-টোয়েন্টিতেও বজায় রাখতে পারতেন নিঃসন্দেহে। তৎকালীন সময় বিবেচনায় তার স্ট্রাইকরেটও ছিল যথেষ্ট ঠিকঠাক। ৭৬.৬৬ স্ট্রাইকরেটে চলেছে তার ব্যাট। তাছাড়া অধিনায়কত্বের বলিষ্ঠ গুণাবলিতেই তিনি জায়গা করে নিয়েছেন আজকের এই একাদশে।
- শহীদ আফ্রিদি (পাকিস্তান)
টি-টোয়েন্টির আলোচনা হবে আর সেখানে শহীদ আফ্রিদির নাম থাকবে না তা কি করে হয়! তিনি তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটাও খেলেছেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের একাদশেও তার জায়গা হয়ে যাবে অনায়াসে। বিশেষ করে তার অলরাউন্ডিং পারফরমেন্সই প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
৪.৭৪ ইকোনমিতে তিনি ৫৬টি উইকেট শিকার করেছেন, লেগ স্পিনের ধুম্রজাল সৃষ্টি করে। তবে ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন সত্যিকারের আগ্রাসন। এই তালিকায় থাকা একমাত্র ক্রিকেটার যার স্ট্রাইকরেটে ১০০ এর বেশি। ১০৩.৯১ স্ট্রাইকরেটে বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্যেই প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। ৮৯ ইনিংসে ২০৬৯ রান করা আফ্রিদি এই একাদশের ফিনিশার।
- ল্যান্স ক্লুজনার (দক্ষিণ আফ্রিকা)
সাত নম্বরে প্রয়োজন একজন অলরাউন্ডার। সে কারণেই ল্যান্স ক্লুজনারকে বেছে নেওয়া। ব্যাট-বলে সমানতালে তিনি পারফরম করেছেন নব্বই দশকে। দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। সেই দশকের স্রেফ চার বছরে ওয়ানডেতে ১৭১৮ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। স্ট্রাইকরেটও ছিল বেশ প্রশংসনীয় ৯৩.৩৬ স্ট্রাইকরেটে দুইটি সেঞ্চুরি ও দশটি হাফসেঞ্চুরি রয়েছে তার নামের পাশে।
এমন আগ্রাসনই তো প্রয়োজন টি-টোয়েন্টিতে ইনিংসের শেষের দিকে। এছাড়া বল হাতেও তিনি ছিলেন প্রায় সমান উজ্জ্বল। ৯৫টি উইকেট রয়েছে তার নামের পাশে। ৬৫ ইনিংসে তার বোলিং গড় ২৬ এর ঘরে। অতএব রান বিলানোর ক্ষেত্রে কার্পণ্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন তিনি ওয়ানডেতে।
- ওয়াসিম আকরাম (পাকিস্তান)
দ্য গ্রেট ওয়াসিম আকরামকে ছাড়া নব্বই দশকের কোন একাদশই করা সম্ভব নয়। সুইংয়ের রাজা বল হাতে ছিলেন ত্রাসের নাম। ওই দশটা বছর বল হাতে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেছেন পাকিস্তানি এই কিংবদন্তি। ১৯৪টি ইনিংসে ২৭৯টি উইকেট গিয়েছে তার ঝুলিতে।
দারুণ ইকোনমিক্যাল বোলার ছিলেন তিনি। স্রেফ ৩.৮৩ হারে তিনি রান দিয়েছেন তার করা প্রতি ওভারে। এছাড়া তার আরও একটি গুণ সর্বদাই থেকে গেছে অগোচড়ে। ব্যাট হাতেও তিনি যথেষ্ট হ্যান্ডি ক্রিকেটার ছিলেন। ২৩৭৪ রান আছে তার নামের সাথে। এই রান আবার তিনি করেছেন ৯০.৬১ স্ট্রাইকরেটে।
- শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া)
কোন প্রকার তর্ক ছাড়াই ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা স্পিনারদের একজন শেন ওয়ার্ন। নব্বইয়ের দশকে তিনিও ঘূর্ণি মায়াজালে বেধেছিলেন প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের। তাকে বাদ রেখে সেই সময়ের যেকোন একাদশ গড়া প্রায় অন্যায়। ১৩১টি ওয়ানডে ইনিংসে তিনি উইকেট শিকার করেছিলেন ২১২টি। যথেষ্ট ইকোনমিক্যাল ছিলেন তিনি।
এক্ষেত্রে উইকেট সংখ্যায় ভারতীয় স্পিনার অনীল কুম্বলে এগিয়ে থাকলেও, ম্যাচের সংখ্যা বিবেচনায় তিনি বাদ পড়েছেন। তাছাড়া বোলিং গড় ও স্ট্রাইকরেটেও শেন ওয়ার্ন এগিয়ে। তাইতো কাল্পনিক এই একাদশে ওয়ার্নই সেরা পছন্দ।
- সাকলাইন মুশতাক (পাকিস্তান)
বলা হয়ে থাকে দুসরা বলের জনক সাকলাইন মুশতাক। সেই নব্বই দশকে আঙুলের কারুকাজে প্রতিপক্ষের ভীত নাড়িয়ে দেওয়ার ওস্তাদ ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি এই স্পিনার ওয়ার্নের চাইতে দুই উইকেট কম শিকার করেছিলেন। ১০৮ ওয়ানডেতে ২১০ খানা উইকেট গিয়েছে তার পকেটে।
গড় ও স্ট্রাইকরেট বিবেচনায় তিনি তার সমসাময়ীক বোলারদের চাইতে ঢের এগিয়ে। সেই সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলা হলে তাকে ছাড়া পাকিস্তানের একাদশ নিশ্চয়ই কল্পনা করা যেত না। তাইতো এমন স্পিন জাদুকরকে রাখা হয়েছে নব্বই দশকের টি-টোয়েন্টি একাদশে, স্পিন ডিপার্টমেন্টকে সমৃদ্ধ করতে।
- ওয়াকার ইউনুস (পাকিস্তানের)
পাকিস্তানের টু-ডব্লিউ নব্বই দশকে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। সেই দ্বৈত বোলিং আক্রমণে ওয়াসিমের সঙ্গী ছিলেন ওয়াকার। সেই দশকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ইউনুসকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওয়ানডেতে ২৭৫ উইকেটের মালিক হয়েছে তিনি স্রেফ একটি দশকে।
সেই সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হলে, তিনি যে একই ধারায় উইকেট শিকারে নিমজ্জিত হতে- তা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন নেই। তাইতো এই একাদশের বোলিং আক্রমণের অন্যতম সেনানী ভাবা হচ্ছে তাকেই।
এই একাদশটা কাল্পনিক। স্রেফ ওয়ানডে ক্রিকেটের বিবেচনায় কল্পনার জগতে নব্বই দশকের সেরা ১১ জনের চিত্র আঁকার এক মামুলি প্রয়াশ। অ্যালান ডোনাল্ড, মুত্তিয়া মুরালিধরন, কার্টলি অ্যামব্রোস, সাঈদ আনোয়ার, অরবিন্দ ডি সিলভার মত রথী-মহারথীরাও ছিলেন বিবেচনায়।
কিন্তু নানা নিরিখে পিছিয়ে পড়েছেন তারা। অনেকের পছন্দের খেলোয়াড়ের নিশ্চয়ই ঠাই হয়নি এই একাদশে। তবে কল্পনার জগতে আপনি, আমি, আমরা সকলেই তো নিজেদের মত একটা একাদশ সাজিয়ে নিতে পারি। ভাবনার দুনিয়া তো সীমাহীন।