১.
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ, ২০০৩। অধিনায়ক সৌরভ জোহানেসবার্গের হোটেলে নিজের রুমে বসে একটা অন্তরঙ্গ আড্ডায় সাক্ষাতকার দিচ্ছেন এক জাঁদরেল বাঙালি সাংবাদিককে ৷ প্রথম চায়ের কাপে চুমুকটা দিতেই প্রশ্নটা এল, ‘আপনার আজকের দলে আর ১৯৮৩ ভারতের বিশ্বকাপজয়ী দলের মধ্যে খেলা হলে কে জিততো?
উত্তরটা এক্সপেক্ট করেননি ওই সাংবাদিক।
‘দাঁড় করিয়ে হারাতাম।’ – সাংবাদিক বুঝলেন স্টেপআউটটা একটা সপাটেই হয়ে গেছে। এবার পরের প্রশ্নে একটা গুগলি দিলেন, ‘কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত সেই দলের আগ্রাসী ব্যাটসম্যান ছিলেন, এখনও শেবাগ আছে কিন্তু…’
এর উত্তরটা এক্সপেক্টেশনের ধারে-কাছে তো দূর, পুরো ব্যাকফায়ার হয়ে গেল, ‘কোথায় শেবাগ আর কোথায় শ্রীকান্ত!”
নাম দুটো কি সৌরভ অবস্থান বদলে কিছু ভুল বললেন? না!
পরে কলকাতায় কপিল দেব ওই সাংবাদিককেই বলেছিলেন, ‘ভিভের সাথে বীরুর ডিফারেন্স একটা জায়গাতেই…’
কপিল পাজি বলে চলেন। সাংবাদিক বুঝে গেলেন যেখানে তুলনার লেভেলটা ভিভ থেকে শুরু হচ্ছে সেখানে শ্রীকান্ত বলে তিনি নিজেই হাস্যকর হয়ে গেছেন।
২.
সে সময়ে অসম্ভব ভালো ক্রিকেট বিশ্লেষক পাকিস্তানের কোচ বব উলমার। ল্যাপটপ স্ক্রিনে ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা ধরতে ওস্তাদ। পাকিস্তান সফরে শোয়েব আখতারকে পাশে বসিয়ে বোঝাতেন অফ স্টাম্পের বাইরের জায়গাটায় কীভাবে পেস কন্ট্রোল করে ব্যাটসম্যানকে স্লিপ বা গালি ফিল্ডারের হাতে জমা করতে হয়।
ভারতের পাক সফরের আগের রাতে একটা দীর্ঘ অ্যানালিসিস চলল কানোরিয়া-শোয়েব-সামিকে নিয়ে ৷ শচীন টেন্ডুলকার আর রাহুল দ্রাবিড় মূল লক্ষ্য। প্রথমদিনে উইকেট তোলার সমস্ত প্ল্যান রেডি পাক বোলারদের।
এক সাংবাদিক ম্যাচ শেষে লিখেছিলেন- ‘শচীন পার করে দিলেন, দ্রাবিড় পার হয়ে গেলেন, সৌরভ মোটামুটি উৎরে গেলেন, আর শেবাগ?’ উলমারের স্ক্রিন দুমড়ে গেল!
৩.
বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে সংস্থার সমীক্ষায় নামগুলো উঠে আসছে। ভারতকে সর্বাধিক টেস্ট ম্যাচ কারা জেতালেন।পরপর নামগুলো এরকমভাবে আসছে- শচীন, দ্রাবিড়, কুম্বলে, গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, লক্ষ্মণ, সুনীল গাভাস্কার।
গৌতম ভট্টাচার্য লিখেছিলেন লিস্টটা হাতে পেলে এক নম্বরে বীরুর নামটা লিখে দেব। বীরেন্দ্র শেবাগ। কী বলা যায়? বিষ্ময়?
টেস্ট ক্রিকেটে একটা মানুষের ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ৮২.২৩। দেশ বিদেশ মিলিয়ে। অর্থাৎ সারাজীবন মেলবোর্ন থেকে লর্ডস, জোহানেসবার্গ থেকে বার্বাডোজ হয়ে মোহালি বা ওয়াংখেড়ে- সারা পৃথিবীজুড়ে ১০ বছরেরও বেশি সময় একটা লোক গড়ে টেস্টে প্রতি ১০০ বলে ৮৩ রান করে গেল। ধারে কাছে কেউ?
ম্যাথু হেডেন অজি শক্তিশালী দলে খেলেও স্ট্রাইক রেট ৬০.০০। টেস্টে ২০০০ এর বেশি রান যাদের রয়েছে তাঁদের কারও স্ট্রাইক রেট বীরুর ধারেকাছে আসবে না। বলছিলেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি।
মাহিকে একবার বলা হল বীরুর ব্যাটিং-এ পায়ের ব্যবহার নেই,বলের লাইনে শরীর নিয়ে যাওয়া-একজন ব্যাটসম্যানের যা প্রাথমিক পাঠ এই লোকটা তো তাকেই অস্বীকার করছে, এমসিসি ক্রিকেট বুক বিরোধী লোকটা।
মাহির উত্তর ছিল যে, বইটা বীরুর ব্যাটিং স্টান্সকে স্বীকৃতি দেয় না কী লাভ ঐ বই রেখে?
কথাটা কিন্তু ভুল বলেন নি মাহি। কোনোদিন পিচ রিপোর্ট দেখতেন না বীরু। বলতেন পিচ দেখে কী হবে, আমি মারার বল মারবই। সিম্পল সে খেলো।
টেস্ট ক্রিকেটে এত তাড়াতাড়ি রান তুললেন লোকটা যে ৯০ ভাগ টেস্ট প্রথম ইনিংসেই পকেটে পুরল ভারত। টেস্টে তিনটে স্লিপ একটা গালির অর্থোডক্স ফিল্ডসেটকে জাস্ট ছুঁড়ে ফেলে দিল একজন। অফস্টাম্পের বাইরে যে হোলটাকে বলা হয় ব্যাটসম্যানের মরণফাঁদ, যেখানে একজন ব্যাটসম্যানকে শেখানো হয় যে, কোন বল খেলবে আর কোন বল ছাড়বে সেই জায়গাটাতে বীরু নামেন এবং ছাড়া-ধরার অনেক ওপর দিয়ে বলটা বাউন্ডারি লাইন পার করে দেন – কী যায় আসে এমসিসি ক্রিকেটবুক এই মানুষটিকে মানল কিনা তা দিয়ে? মাহি তো ভুল বলেন নি!
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে শেবাগ একজনই। শেবাগ হতে গেলে মাথার ভেতরটা পরিস্কার রাখতে হয়। শেবাগ হতে গেলে মনের ভেতর গেঁথে নিতে সামনে যে-ই থাক আমার খাদ্য সে।
শেবাগ হতে গেলে একটা বেপরোয়া মানসিকতাকে মনে বয়ে বেড়াতে হয় যা ছিঁড়ে ফেলে জটিল ক্যালকুলাস, গেয়ে ওঠে – ‘জিন্দেগি এক সাফার হ্যায় সুহানা…’, শেবাগ হতে গেলে তিনবার ট্রিপল সেঞ্চুরির দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়েও ছয় মারতে গিয়ে ২৯৩ রানে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ক্রিজ ছাড়তে হয়।
মাহি বলেছিলেন, ‘আমি বিপক্ষ অধিনায়ক হলে বীরুর গায়ে লেগসাইড ঘেঁষে ১৪৫ কিমি পেসে শর্ট পিচ দিতাম। নইলে এই মানুষটাকে থামানো যেত না।’ হয়তো! আবার ২০০৩- এ গ্লেন ম্যাকগ্রার বডি ঘেঁষা বলগুলো যখন প্যাভিলিয়নে পাঠাতেন সবুজ টপে তখন যেন সব হিসেব ওলটপালট হয়ে যায়।
শেবাগ একজনই, শচীন বা রাহুল দ্রাবিড় হয়ে চিরন্তন জ্যোৎস্না হয়ে তিনি থাকতে চান নি ভারতীয় ক্রিকেটে। তিনি পঞ্চপাণ্ডবের ভীম যার ভয়ে গুটিয়ে যেত অজিরা, যাকে বল করতে ভয় পেতেন শোয়েব থেকে লি, যার ব্যাটিং-এর সময় বিপক্ষ অধিনায়কের মাথায় থাকত দশ ওভার বীরু টিকে গেলে ম্যাচ ভারতের হয়ে যাবে – ভারতের হয়ে প্রথম আঘাতেই যে লোকটা প্রতিপক্ষের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতেন তাঁর নাম বীরেন্দ্র শেবাগ- নজফগড়ের নবাব!
রমিজ রাজার গলাটা ভেসে আসে আজও, ‘যখন ভিভ অবসর নিল, আমি ভাবলাম সকল বিনোদনে শেষ। কিন্তু, এরপর আসলো শেবাগ। বাকিটা ইতিহাস!’
ভারতের নটরাজ মেতেছিলেন আপন ছন্দে, তাঁর প্রলয় নৃত্যে লেখা হয়েছিল কত ইতিহাস, তাঁর জটার বাঁধন খুলে নদী স্তন্যে সম্বৃদ্ধ হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট সভ্যতা।