জিদানের খোলা চিঠি

প্রিয় রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তরা,

প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, প্রথম যেদিন রিয়াল মাদ্রিদে পা রেখেছিলাম, জার্সিটা গায়ে চড়িয়েছিলাম, সেই মুহূর্ত থেকেই আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি আমি। সবসময় মনে হয়েছে আমাদের মধ্যে একটা বিশেষ আছে। সর্বকালের সেরা ক্লাবের খেলোয়াড় ও কোচ হওয়ার সম্মান পেয়েছি আমি।

কিন্তু সবকিছুর পরেও আমি আপনাদের মতই একজন রিয়াল মাদ্রিদের ভক্ত। আর সে কারণেই আপনাদের উদ্দেশ্যে আমি চিঠিটা লিখছি, আপনাদের বিদায় ও আমার সিদ্ধান্ত ব্যাখা করার জন্য।

২০১৯ সালের মার্চে যখন আট মাসের বিরতির শেষে আবার মাদ্রিদে ফেরার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম, সেটা শুধু ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ চেয়েছিলেন বলে নয়, বরং আপনারাও চেয়েছিলেন বলে। রাস্তাঘাটে, চলাফেরার পথে যখনই আমার সাথে আপনাদের দেখা হতো, আপনাদের সমর্থন আমি পেয়েছি, বুঝেছি আপনারা আবারও আমাকে ফিরে পেতে চাইছেন।

রিয়ালের অবস্থানটা আমি বুঝি, এই ক্লাব শুধু নিজেদের নয় বরং পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি মেম্বার, ভক্ত, সমর্থকের। আমি সেই অনুযায়ী একটা দৃষ্টান্ত হতে চেয়েছি। মাদ্রিদে থাকা ২০ বছর আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়।

২০০১ থেকেই ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আমার পাশে ছিলেন, কিছু লোক আমাকে চাইতেন না, বিরোধিতা করতেন, তারপরেও আমাকে যেভাবে সাপোর্ট করেছেনসেটা অনেক বড় ব্যাপার। সেজন্য আমি সবসময় বলি, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

এখন আমি আমার চলে যাওয়ার কারণটা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করব। আমি হুট করে চলে যাচ্ছি না কিংবা কোচিং করাতে করাতে ক্লান্ত সেজন্যও যাচ্ছি না। ২০১৮ সালের মে মাসে আমি চাকরিটা ছেড়েছিলাম কারণ আড়াই বছরে অনেককিছু অর্জন করে ফেলেছিলাম আমি।

আমার মনে হয়েছিল এতকিছুর পর ক্লাবে নতুন কিছু দরকার। রিয়াল মাদ্রিদ সবসময়ই সর্বোচ্চতে থাকতে চেয়েছে এবং সেজন্য ক্লাবে নতুন চিন্তা ভাবনা দরকার, পরিবর্তন দরকার। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম। আমি চলে যাচ্ছি, কারণ আমার মনে হয়েছে যে ক্লাব আমার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।

অন্তত আমি যেটুকু চাচ্ছি সেটুকু তো নয়ই। আমার মনে হয়েছে মাঝারি কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে এখানে থাকার জন্য যে পরিমাণ সমর্থন দরকার সেটা আমি ক্লাব থেকে পাচ্ছি না। আমি ফুটবলটা বুঝি, জানি রিয়ালের মতো ক্লাব কী চায়। আমি জানি এখানে জিততে না পাড়লে আপনাকে পদটা ছেড়েই দিতে হবে। কিন্তু এর মাঝেই অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা অনেক সময় ভুলে যায়, সেটা হলো আমি কীভাবে দলকে তৈরি করেছি, খেলোয়াড় ও ক্লাবের ভেতরে আরো প্রায় ১৫০ লোকের সঙ্গে আমি যে সম্পর্ক তৈরি করেছি।

আমি ন্যাচারাল-বর্ন উইনার। আর এখানেও ট্রফি জিততে এসেছি। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আবেগ-অনুভুতি, জীবনযাপন; অনেক সময় এগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। একটি গ্রেট ক্লাবের জন্য এই ব্যাপারগুলো বোঝা বেশ জরুরি। এমনকি এটা নিয়ে কথা বলার জন্য আমাকে কথাও শুনতে হয়েছে।

আমরা সবাই মিলে যা যা অর্জন করেছি সেজন্য কিছুটা হলেও সম্মান আমার প্রাপ্য। আমি আশা করেছিলাম, গত কয়েক মাসের অবস্থা দেখার পর ক্লাব ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্যান্য কোচদের থেকে আলাদা হবে। আমি আলাদা করে কোনো সুবিধা আশা করিনি। আমি জানি বর্তমান সময়ে বড় ক্লাবের ডাগআউটে কোচরা থাকেই দুই মৌসুমের মতো।

কিন্তু এর চেয়ে বেশি সময় থাকতে হলে বেশ ভালো সম্পর্ক প্রয়োজন। যশ-খ্যাতি, টাকার চেয়েও বেশি জরুরি সেটা। এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হয়, লালন-পালন করতে হয়। সেজন্যই আমার বেশ খারাপ লেগেছে যখন একটা ম্যাচ হারার পর আমাকে ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করা হয়েছে আমি দল ছাড়ছি কীনা? আমার চাকুরি চলে যাবে কি না?

আমার এবং আমার দলের কিছু কথায় বেশ আঘাত লেগেছে, যখন দেখেছি ইচ্ছে করে কেউ ভেতরের কথা বাইরে ফাঁস করছে। যাতে করে আরো বেশি ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। আমার ভাগ্য প্রচন্ড পরিমানে ভালো যে আমার এমন একটা স্কোয়াড ছিল যারা আমার জন্য জীবনও দিতে পারে। প্রচণ্ড বাজে সময়ে তারা আমার পাশে ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তারা আমাকে জিতিয়েছে।

পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ছিল আমাদের। অবশ্যই আমি বিশ্বের সেরা কোচ নই। কিন্তু খেলোয়াড়, মেম্বার, কোচিং স্টাফ বা রিয়ালের যে কারো প্রতিদিন যে শক্তি আর আত্মবিশ্বাস দরকার হয়, আমি মনে করি আমি সেটা দিতে পারি। গত ২০ বছরে আমি দেখেছি, জেনেছি ভক্তরা সবসময় জিততে চায়। কিন্তু তার আগে তারা চায় কোচ, স্টাফ, খেলোয়াড়সহ সকলে নিজের সর্বোচ্চটা দিক। আমি নিশ্চিত করতে পারি, সেই শতভাগ আমি দিয়েছি।

এই সুযোগে আমি সাংবাদিকদেরও একটা কথা বলতে চাই। আমি প্রচুর সংবাদ সম্মেলন করেছি, কিন্তু সেখানে ফুটবল নিয়ে কথা হয়েছে কালেভদ্রে। আমি জানি আপনারা ফুটবলকে ভালোবাসেন, ফুটবলের কারণেই আমাদের যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে আমরা কাছকাছি এসেছি।

কিন্তু কোনো সমালোচনা কিংবা উপদেশ না দিয়েই বলতে চাই, কন্ট্রোভার্সি নিয়ে প্রশ্ন না করে খেলা নিয়ে করলে হয়তো আমরা আরও বেশি কথা বলতে পারতাম, কারণ দিন শেষে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফুটবলের জন্যই আমরা বেঁচে আছি।

মাদ্রিদিস্তারা, আমি তোমাদের আছি, সবসময়ই থাকব।

আলা মাদ্রিদ!

জিনেদিন জিদান

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link