সুবিশাল সুনীল আকাশ

দিনের আলোর মত পরিস্কার, সুনীল ছেত্রীর রিপ্লেসমেন্ট বা ভাল কোনও স্ট্রাইকার ভারত পায়নি এখনও। অসীম বিশ্বাসের পর বলতে গেলে কোনও বাঙালি স্ট্রাইকার দেশের জার্সি গায়ে দেয় নি। সুনীলের বয়সও প্রায় ছত্রিশের কোঠায়।

এই বয়সে টানা নব্বই মিনিট একই দমে দৌড়ে যাওয়ার ক্ষমতা সুনীল তার ফিটনেসের মাধ্যমে বজায় রেখে গেছে। কিন্তু সে আর কদ্দিন! সারাজীবন তো ভারতের ফরোয়ার্ড লাইনে সুনীল থাকবে না। কাউকে না কাউকে তো উঠতেই হবে। এখন প্রশ্ন হল, বিশ্ব ফুটবলে এত রদবদল ঘটে যাওয়া সত্বেও ভারত পা মিলিয়ে চলতে পারল না কেন?

উত্তরটা খুব সহজ। কিন্তু মানতে পারাটাই কঠিন। বিশেষত যারা ভারতীয় ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, আমাদের দেশে এখন আইএসএলই শেষ কথা। আর কোনও ঘরোয়া টুর্নামেন্ট নেই, নেই ট্যালেন্ট হান্ট। পরিস্কার ক’রে বললে, গ্রাউণ্ড লেভেল থেকে ফুটবলার উঠে আসার যে প্রকল্প গোটা বিশ্বে চলে তার কোনও ছায়া ভারতীয় ফুটবলে দেখাই যায়নি গত কয়েক বছর ধরে।

ডুরাণ্ডের মত টুর্নামেন্ট বেশ কয়েক বছর হল অস্তাচলে। ফেড কাপের মত টুর্নামেন্ট, যেখানে বহু প্লেয়ার উঠেছে ভাল খেলে (এখনও মনে পড়ে ইস্টবেঙ্গলের বুধিরাম টুডু অথবা মোহনবাগানের কার্তিক কিস্কুকে), তাও গেল বন্ধ হয়ে। একসময়ের টানা কলকাতা লিগ খেলা নেই। আই লিগ এসে এখন ঠেকেছে তলানিতে।

এই টুর্নামেন্টগুলো করা কীসের খোঁজে? ভাল ট্যালেন্টের খোঁজেই। তা সেগুলোই যদি ক্রমে ক্রমে অন্ধকারের মুখ দেখে, একটা আইএসএলের খান কুড়ি ম্যাচ কি আর ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির দরজা হতে পারে|

সোজা কথা, কর্মকর্তারা টাকা চেনে। ব্যবসা চেনে। ফুটবল চেনে না। এখনকার কর্মকর্তারা কেউ ধীরেন দে বা পল্টু দাস নয় যে শীতকালের ভোরে গৌতম সরকারের খোঁজে চুনী গোস্বামীকে বাড়িতে পাঠাবে। পেছন থেকে চলে আসবে নৃপেন দাস। সে সব দিন চলে গেছে। একসময় মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড, জেসিটি ফুটবলার তুলেছে।

সুরকুমার সিংয়ের মত উইঙ্গার আমি তো বলব ভারতীয় দলে খুব কম এসেছে। ৫-৩ এর ম্যাচে ডানদিক থেকে ডজ করতে করতে একটা ছোট্ট চিপ তুলে চিডিকে অ্যাসিস্ট করা সুরকুমার আজ পুলিশের চাকরি করছে! একটা বাংলাদেশ ম্যাচ জেতা মানেই আমরা শুধু সুনীলের জয়গান গেয়ে পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে সব ভুলে যাব – এই যদি মনোভাব হয়, তবে এরপরের দশকে শুধু ইউরোপীয়ান আর কনকাকাফ টুর্নামেন্ট নিয়েই লিখতে হবে। ভারতীয় ফুটবলের সলিল সমাধি ঘটে যাবে।

ছোট ক্লাবগুলো স্পনসর না পেতে পেতে একসময় ডুবেই গেল। এখানে সমর্থক বলতে শুধু মোহন-ইস্ট। কেউ টালিগঞ্জ এফসির সাপোর্টার নয়, কেউ ভবানীপুরের সাপোর্টার নয়, কেউ মহামেডানের সমর্থক নয়। রঘু নন্দীর মত পাকা কোচেদের আর ময়দানে দেখা যায় না। বিশ্বজিত ভট্টাচার্য, শঙ্করলার চক্রবর্তীরা ময়দান থেকে উধাও। কী করে থাকবে, কেনই বা থাকবে!

যেখানে এভারটনের কোচ হয়ে আসেন কার্লো আনচেলত্তি, শেষ বয়সে দিদিয়ের দ্রগবা খেলতে যান গালাতাসারেতে, অ্যাস্টন ভিলা-শেফিল্ড ইউনাইটেডের ম্যাচেও সমর্থকরা মেক্সিকান ওয়েভে ভাসে, সেখানে আমরা তো কার্যত বাতাসে উড়ে গেছি বলা যায়!

টাকা ঢাললে ঠিক জায়গায় ঢালতে হয়। ভুলভাল জায়গায় নয়। লুই গার্সিয়া, লুসিও, ডেভিড জেমস, জিকোদের এনে ভারতীয় ফুটবলের উপকার হয় না। জাভি-ইনিয়েস্তা বার্সা জুনিয়র অ্যাকাডেমির ফসল। অ্যাকাডেমি চাই। ট্যালেন্ট হান্ট চাই। না হলে বছরের পর বছর শুধু শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশকে হারিয়েই (পরে আবার উল্টোটা না হয়!) ক্ষান্ত থাকতে হবে।

ব্রেন্ডন, রাওলিন, সন্দেশ, চিংলেসানা, ঈশান পাণ্ডিতাদের আরও স্ট্রং করার জন্য তুলনাহীন খাটনির ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। ইগর স্টিমাচ ভাল কোচ, কিন্তু অ্যাকচুয়ালি টিমটাকে তৈরি করতে পারতেন স্টিভন কন্সট্যান্টাইন। ভারতীয় ফুটবল নিয়ে অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। ক্লাব ফুটবলে টুর্নামেন্ট চালু করতে হবে। সারাদেশ ঘুরে ক্লাবগুলোকে খেলতে হবে। না হলে শুধুই দিবাস্বপ্ন, এই হবে ললাটলিখন।

আর সুনীল ছেত্রী? ভুল সময়ে ভুল দেশে জন্মানো কিংবদন্তি, আমি তো তাই বলব। এবার মেসিকে টপকে গেল গোলসংখ্যায়। জাত শিল্পীদের ওভাবে হিসেব দিয়ে, অঙ্ক দিয়ে, স্কোর দিয়ে বিচার করা যায় না। তাঁরা শিল্পীই হয়। দিনশেষে বারান্দায় বসে ঘরে ফেরার গান গায়। যারা ইতিহাসের পাতায় অমর, ওভাবে সুনীলদের মাপা ইম্পসিবল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link