দ্য আদার মরকেল

হতে পারতেন দক্ষিণ আফ্রিকার পরবর্তী ল্যান্স ক্লুজনার। কিংবা নিদেনপক্ষে শন পোলক, যিনি ব্যাট হাতেও আগ্রাসী। অন্তত জ্যাক ক্যালিস না হোক, লম্বা সময় পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সার্ভিস দেওয়ার সব রকম সামর্থ্যই ছিল অ্যালবি মরকেলের। বিশেষ করে তাঁর বলকে পেটাতে পারার ক্ষমতা আধুনিক ক্রিকেটে খুব কার্যকর ছিল।

কিন্তু, সবাই কি আর তাল মেলাতে পারে! চোকারদের ক্রিকেট শক্তি দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যালবি মরকেলও চোকই করেছিলেন।

জোহাসেন আলবার্টাস মরকেল – ক্যারিয়ারের গোড়ায় শন পোলক বা ল্যান্স ক্লুজনারের সাথে তুলনাই তাঁর জন্য কাল হয়েছে। বরং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তাঁর হাঁকানো বিরাট বিরাট সব ছক্কা আক্ষেপ বাড়িয়েছে।

ক্যারিয়ারের অর্ধেকটা সময় নিজেকে খুঁজে পেতেই নষ্ট করেছেন৷ এলবি মরকেলের কথা উঠলে সবার আগে আসবে তার ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ক্যারিয়ার। জাতীয় দলে ক্যারিয়ারের আর্ধেক সময় নিজেকে মেলে ধরতে না পারা ছেলেটা আইপিএলে এসেই নিজেকে খুঁজে পেলেন।

বোলিংয়ে ইকোনমি ঠিক রেখে রান আটকানোর সাথে সাথে ব্যাটিংয়ে তার পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটি মূলত তাকে আইপিএলে টেনে আনে। ব্যাস সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে মেলে ধরলেন আইপিএলের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে ৷ এই সুযোগটা মূলত চেন্নাই সুপার কিংসই করে দিয়েছিল তাঁকে। ২০০৮ সালে আইপিএলের উদ্বোধনী আসরে তাঁকে দলে ভেড়ায় চেন্নাই।

এবার আবার গোড়ায় ফিরে যাই। কাটু টু ১০ জুন, ১৯৮১।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী জোহানেসবার্গ থেকে ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভিরিনঙ্গিং নামক অঞ্চলে জন্ম নেন অ্যালবি মরকেল। মূলত ক্রিকেট পরিবারেই তার জন্ম হয় ৷ অ্যালবি মরকেলের বাবা আলবার্ট মরকেল ছিলেন একজন ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে না পারলেও খেলছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। তিন ভাইদের মধ্যে এলবি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বড় ভাই মালান মরকেলও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। আর ছোট ভাই মরনে মরকেলকে আপনার না চেনার কোনো কারণ নেই! ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর পেসারদের একজন ছিলেন তিনি।

এলবি প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন অনূর্ধ্ব-১১ দলের হয়ে খেলতেন। শেষ দিকে ব্যাটিং আর বোলিংটাও পেতেন টুকটাক। তবে সমস্যাটা হয়েছিল ক্রিকেট কিট নিয়ে। স্কুলের ক্রিকেট কিট মূলত ছিল ডান হাতি ক্রিকেটারদের জন্য! আর এলবি ছিলেন বাঁ-হাতি। যার কারণে তিনি খুব বেশি কিট ব্যবহার করতে পারতেন না, যতটুক ব্যবহার করার মতো পেতেন সেটাই করতেন। তবে তিনি সব সময়ই চাইতেন অনেক রান করবেন! মৌসুমের পর মৌসুম রান করে বাবাকে ব্যক্তিগত কিট কিনে দেওয়ার জন্য মানাবেন।

সেই সময়ে সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলসের ব্যাটিং দেখে তিনি তাঁর ভক্ত বনে গিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন ওয়েসেলসের মতো করে খেলতে। মরকেলরা তিন ভাই মূলত বাড়ির পেছনের খালি জায়গায় প্রতিবেশি বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। সেখানে লাইট থাকায় রাতের বেলায়ও চলতো খেলা। দিন-রাত খেলতে থাকায় স্কুলের বাড়ির কাজটাও অধরা থাকতো। বাবা অবশ্য কিছু বলতেন না কারণ তিনি নিজেও যে একজন ক্রিকেটার ছিলেন।

তিন ভাই মিলে যত জানালার কাঁচ ভেঙে বাবা আলবার্ট মরকেল তার একটি ঠিক করেননি। অবশ্য বাবা বেশ চালাকও ছিলেন। যতদিন না জানালাগুলোর সব কাঁচ ভাঙা শেষ হয় ততদিন তিনি সেটা মেরামত করতেন না। তিনি চাইতেন সবগুলো একবারেই ঠিক করতে। এলবি মরকেল নিজেও তার বাবাকে অঞ্চলভিত্তিক ক্রিকেট খেলতে দেখেছেন৷ ট্রান্সভালের হয়ে বাবা ক্রিকেট খেলতেন। সেই ট্রান্সভাল অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার সুযোগ পান অ্যলবি। যেখানে তিনি সাবেক প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের সাথে ওপেনিংয়ে ব্যাট করতেন। মূলত সেখানে ভালো খেললেই ট্রান্সভালের বি দলে সুযোগ মিলত খেলার।

এরপর সেখান থেকেই ১৯৯৯ এর অক্টোবরে ইস্টার্ন্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় এলবির। এবং অভিষেক ম্যাচেই খেলা পড়ে নর্দান ট্রান্সভালের সাথে যারা কিনা বেশ অভিজ্ঞ আর শক্তিশালী দল ছিল। প্রথমে ব্যাট করে নর্দান ৪০০ রান সংগ্রহ করে। জবাবে বেশ অল্প রানেই গুড়িয়ে যায় ইস্টার্ন্স ট্রান্সভাল। এলবির ভাষ্যমতে, নর্দানের দুই পেসার গ্রেগ স্মিথ ও স্টিভ এলওয়ার্থি এত গতিতে বল করছিলেন যা তিনি তার ১৮ বছরের জীবনে আর দেখেননি! ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকেই তিনি আরেক ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী ছিলেন!

তখন ইস্টার্নন্সে তাঁদের দলে বিদেশি কোটায় এক পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান শাকিল আহমেদ খেলছিল। শাকিলের নাকে লাগা বলে পুরো নাক ফেটে যায়! প্রচুর রক্ত ঝড়ছিল! সেখানে না ছিল কোনো ফিজিও না কোনো ডাক্তার। সেই সময়ে তাঁদের কোচ রে জিনিংস একাই ছিলেন তাদের ফিজিও, কোচ, ফিটনেস ট্রেইনার সব! কোচ তুলা দিয়ে রক্ত বন্ধ করার পর যখন বললেন পরের উইকেট পড়লে শাকিল আবার ব্যাটিংয়ে নামবে! এটা শুনে অ্যালবি মরকেল সহ বাকি সতীর্থরা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। শাকিলের এই অবস্থায় যেখানে তাকে হাসপাতালে নেওয়া উচিত সেখানে কিনা সে আবার ব্যাটিংয়ে নামবে কোচ কি মজা করছে! এমনটাই ভাবনা ছিল সবার।

তখন ক্রিজে ব্যাট করছিলেন এলবি মরকেল। এক উইকেট পড়ার পর আবারো নামলেন শাকিল। তার পুরো মুখেই রক্ত মাখানো! নাকের অবস্থা ভয়াবহ! রক্তে চোখ প্রায় বন্ধ হবার অবস্থা। এলবির ভাষ্যমতে, সৌভাগ্যক্রমে কয়েকবল পরেই শাকিল আউট হয়ে যায়। অবশ্য সেই কোচ রে জিনিংসই এলবির অসাধারণ পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটির কারিগর। তিনিই অ্যালবিকে বলেছিলেন আরো আগ্রাসী হয়ে ব্যাট করতে! এই উপদেশটাই মূলত অ্যালবির জীবনের পরিবর্তন এনে দেয়।

এরপর নর্দান্স দল ধীরে ধীরে আরো শক্তিশালী হলো। একদিন বিকেলে নর্দান্স দলে এলবি এক গতিময় পেসার দেখলেন যিনি অনেক স্পিডে বল করছিলেন! নাম তার ডেল স্টেইন। যিনি পরবর্তীতে ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে। সেখানে পেসার পল হ্যারিসও ছিলেন। তবে হটাৎ এলবি একটু অবাক হন আশেপাশে সবাই যেন কাকে নিয়ে কথা বলছে! একপাশে দেখলেন এক ছেলে গিটার বাজাচ্ছে। সবাই তার নাম বলছিলেন ‘আব্রাহাম’। কি চিনতে কষ্ট হলো? বর্তমানে ৩৬০ ডিগ্রি হিসেবে খ্যাত এবি ডি ভিলিয়ার্সই ছিলেন সেই ছেলেটা।

এরপর এলবির অলরাউন্ডার কারণে ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে প্রথমবারের মতো ডাক পান তিনি। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা দলে জ্যাক ক্যালিস, নিকি বোয়ে ও শন পোলকের মতো অলরাউন্ডার ছিলেন। তৃতীয় ওয়ানডেতে ভালো করা সত্ত্বেও জ্যাক রুডলফকে বসিয়ে সুযোগ দেওয়া হলো মরকেলকে। কিন্তু ব্যাট হাতে মাত্র ৬ রান করেন তিনি। পরের ম্যাচে আবার জায়গা হারালেন! এরপর শেষ দুই ওয়ানডেতে দলে ফিরলেন। কিন্তু আহামরি খুব ভালো কিছু করতে পারেননি। সেই সাথে ওই সিরিজে তার খেলা তিন ওয়ানডেতেই হারে প্রোটিয়ারা।

এরপর ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়। মূলত দুই ফরম্যাটেই তাকে সুযোগ দেওয়া হলেও তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারছিলেন না। তিনি নিজের মাইন্ডসেটই করতে পারছিলেন দলে তিনি কোন ভূমিকা পালন করবেন। মূলত এটাই তার ক্যারিয়ারের অর্ধেক সময় নষ্ট করে৷ পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেওছিলেন যে সুযোগ পেলে আবার সেই সময়ে ফিরে যেতে চান কারণ এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন তার কিভাবে খেলা উচিত ৷ এটা ছাড়া অধারাবিহকতা আর এলবো ইনজুরিতে মূলত তিনি পিছিয়ে গেছেন।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং স্ট্রাইক রেটের কারণে পরবর্তীতে ২০০৮ আইপিএলের উদ্বোধনী আসরে সুযোগ পেয়ে যান চেন্নাই সুপার কিংসে। এই চেন্নাইয়েই মূলত তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা দলে তার থেকে সেরাটা বের না করতে পারলেও চেন্নাই সুপার কিংস তার সেরাটা বের করতে সফল হয়েছিল। এজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক গণমাধ্যমেই বলা হয় এলবি মরকেলের তৈরির পিছনে ভারতেরই অবদান বেশি।

২০০৮ থেকে ২০১৩ এই ছয় আসরে আইপিএলের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন এলবি মরকেল৷ ৭৮ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় প্রায় ২৪ আর বোলিং গড় ছিল ২৭! যার জন্য কিনা তিনি রবীন্দ্র জাদেজা, জ্যাক ক্যালিসদের চেয়েও উপরে ছিলেন সেরাদের তালিকায়। আইপিএলে তিনি ২০১৬ আসর পর্যন্ত খেলেছিলেন। যদিও ২০১৪ পর্যন্তই তিনি দলে অনেকটা নিয়মিত ছিলেন। আইপিএলে ৯১ ম্যাচে ২৪.৩৫ গড়ে ৯৭৪ রান করেছিলেন তিনি। তিন ফিফটির সাথে তার স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ১৪২! সেই সাথে ঝুলিতে পুড়েছেন ৭৫ উইকেট। চেন্নাই সুপার কিংস ছাড়াও তিনি দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে খেলেছেন।

তার আইপিএলে ক্যারিয়ারের কথা আসলে বিরাট কোহলির এক ওভারে ২৮ রান ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে রাখার কথা। ২০১২ সালে চেন্নাইয়ে চেন্নাইর বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে গেইল ও বিরাটের ফিফটিতে ৮ উইকেটে ২০৫ রান করে ব্যাঙ্গালুরু। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শেষ ২ ওভারে দরকার ছিল ৪৩ রান! বোলিংয়ে তখন বিরাট কোহলি। ওই ওভারে তিন ছয়, দুই চার আর এক ডাবলসে ২৮ রান নিয়ে ম্যাচ বের করে আনেন অ্যালবি মরকেল। শেষ ওভারে ১৫ রান লাগলেও ব্রাভো, জাদেজার ব্যাটে জয় তুলে নেয় চেন্নাই।

এলবি মরকেল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৫৮ ওয়ানডেতে ৭৮২ রান আর ৫০ উইকেট সংগ্রহ করেন। মাত্র তিন রানের জন্য সেঞ্চুরির দেখা পাননি তিনি, সর্বোচ্চ ৯৭ রান। টি-টোয়েন্টিতে ৫০ ম্যাচে ৫৭২ রান আর নিয়েছেন ২৬ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৬১৮ ম্যাচে ১২,৩৫৯ রান ৬৬৬ উইকেট নিজের নামে করেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একবার ৬ উইকেট আর সেই সাথে ব্যাট হাতে একবার করেছেন ডাবল সেঞ্চুরি।

তার টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে একটু আলাদা ভাবেই বলতে চাই। তিনি তার পুরো ক্যারিয়ারে মাত্র একটি আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলেছেন। সেটাও কিনা নিজের ছোট ভাই মরনে মরকেলকে বসিয়ে তাকে সুযোগ দেওয়া হয়! আর সেই ম্যাচে তিনি মাত্র ১ উইকেট শিকার করেন, তবে ব্যাট হাতে ৫৮ রানের একটি ইনিংস খেলেন। এরপর আর কখনোই সাদা পোশাকে নিজেকে দেখাতে পারেননি এই বোলিং অলরাউন্ডার৷

পুরো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইনজুরি আর অধারাবাহিকতাই মূলত তার ছোট পরিসংখ্যানের কারণ। ক্যারিয়ারের যা কিছু অর্জন সেটাও চেন্নাই সুপার কিংসের হয়েই। চেন্নাইর হয়ে দুইবার তিনি শিরোপা হাতে নেন। অবশ্য তিনি না পারলেও তারই ছোট ভাই নিজেকে নিয়ে গেছেন আরো অনন্য উচ্চতায়। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবেই নিজেকে রেখে গেছেন মরনে মরকেল। তবে অ্যালবি মরকেল আক্ষেপ করতেই পারেন! যদি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকটায় নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্যের বিচার করতে পারতেন তাহলে হয়তো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা আরো দীর্ঘ হতো।

একটু আগেভাগেই ক্যারিয়ারটা শেষ করেছেন তিনি। সর্বশেষ প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেট খেলেছেন ২০১৮ সালে। তখন তাঁর বয়স ৩৬ কি ৩৭। কে জানে, খেলাটির প্রতি ভালবাসা হয়তো আর অবশিষ্ট ছিল না।

– ক্রিকেট মান্থলির ছায়া অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link