দ্য বিগ বার্ড এবং অন্যান্য

কিছুদিন আগে টেস্ট বোলার ওয়াসিম আকরামকে নিয়ে একটা লেখার প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন বেশ কয়েকবার উঠে এসেছিল – একদিনের ক্রিকেটের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বোলার কাকে বলা যেতে পারে?

যেহেতু একদিনের ক্রিকেটের মেয়াদ টেস্ট ক্রিকেটের তুলনায় অনেক কম, এই বিষয়ে বেশ কিছুটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে যার ভিত্তিতে একটা আলোচনা করা যেতে পারে।

একদিনের খেলাকে গুরুত্ব দেওয়া মোটামুটি ১৯৭৫ সাল থেকে আরম্ভ হয়, যে বছর প্রথম বিশ্বকাপের আসর বসেছিল। ক্রমে এর গুরুত্ব এবং সংখ্যা, দুটোই বাড়তে থাকে। আমরা যারা ১৯৮২-৮৩ থেকে ক্রিকেট দেখা বা ক্রিকেট সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখা আরম্ভ করেছি তাদের পক্ষে একদিনের ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা আছে। আর তার ওপর ইন্টারনেটের কল্যানে আঙুলের ডগায় পরিসংখ্যান তো আছেই।

এই লেখায় নিজের আলোচনা শুধু ফাস্ট বোলারদের মধ্যেই সীমিত রেখেছি (এর মধ্যে মিডিয়াম ফাস্ট বোলাররাও থাকবেন)। তিন প্রজন্মের মোট দশজন বোলার থাকবেন আমাদের বিবেচনায়।

এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ করে নেওয়া ভাল – একদিনের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের দাপট ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে বোলারদের ইকোনমি রেট একটু হলেও কমেছে। সেইজন্যে কোন বোলার কোন সময়ে ক্রিকেট খেলেছেন তার বেশ কিছুটা গুরুত্ব আছে।

আলোচ্য বোলারদের একটা নির্দিষ্ট বছরের ক্রিকেটার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। এই বছর নির্ধারিত হয়েছে যে বছরে তিনি নিজের মোট উইকেটের পঞ্চাশ শতাংশ উইকেট নিয়েছিলেন। যেমন ধরুন ওয়াসিম আকরামের মোট ৫০২ উইকেটের মধ্যে ৫০% অর্থাৎ ২৫১তম উইকেট উনি পান ১৯৯৪ সালে যেটাকে আমরা তার সময় হিসবে ধরে নেব।

এই নিয়মে আমাদের প্রথম দুই আলোচ্য বোলারের সময়কাল ১৯৮৪ সাল।

‘বিগ বার্ড’ নামে খ্যাত ছয় ফুট আট ইঞ্চির দৈত্যাকার জোয়েল গার্নার হচ্ছেন এই লিস্টের প্রথম নাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির অন্যান্য বোলারদের তুলনায়, যেমন অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং বা ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার খুব একটা দ্রুতগতির ছিলেন না। তবে তার লাইন আর লেন্থের ওপর নিয়ন্ত্রন ছিল অসাধারণ। তা ছাড়া ভদ্রলোক নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত অসুবিধেজনক লেন্থ থেকে বাউন্স আদায় করে নিতেন।

একদিনের ক্রিকেটে গার্নারের পরিসংখ্যান দুর্দান্ত। ৯৮ টি ম্যাচে উইকেট প্রতি ১৮.৮৫ রান দিয়ে ১৪৭ টি উইকেট নেন গারনার। ওভার পিছু তার দেওয়া রান মাত্র ৩.১ – অর্থাৎ পুরো ৫০ ওভার বল করার সুযোগ পেলে গারনার মাত্র ১৫৫ রান দেবেন। আইসিসির তৈরি লিস্টে একদিনের ক্রিকেটে সর্বকালের সর্বাধিক পয়েন্ট জোয়েল গার্নারেরই – ৯৪০। সব মিলিয়ে গার্নারকে সীমিত ওভারের বোলারদের মধ্যে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ ধরা হয়। ক্রমে আমরা দেখব ওনার তৈরি বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করা কতটা কঠিন।

লিস্টের দ্বিতীয় নামটি অবশ্য সব ক্রিকেট প্রেমীর কাছেই পরিচিত – স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তবে এই ভদ্রলোকের মূল উৎসাহ রান আটকানোর চেয়ে উইকেট নেওয়াতেই বেশি দেখা যেত। টেস্টে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারদের মধ্যে হ্যাডলির স্থান নিয়ে তেমন কোন বিতর্ক নেই। তবে একদিনের ক্রিকেটেও হ্যাডলির পারফর্মেন্স ফেলে দেওয়ার মতো একেবারেই নয়।

তবে তাতে আশ্চর্যেরও কিছু নেই। যার মূল অস্ত্র অভ্রান্ত স্যুইং, লেন্থ আর লাইন, তার বল খেলতে সব ব্যাটসম্যানদেরই অসুবিধে হওয়ার কথা। সেই সঙ্গে রান করতে।

হ্যাডলিরও সময়কাল ১৯৮৪। মোট ১১৫ ম্যাচে ১৫৮ উইকেট নিয়েছেন হ্যাডলি, গড় – ২১.৫৬। ওভার পিছু রান দিয়েছেন ৩.৩১। আই সি সির লিস্ট অনুযায়ী হ্যাডলির সর্বাধিক পয়েন্ট ৯২৩, সর্বকালের নিরিখে ঠিক গারনারের পরেই।

রিচার্ড হ্যাডলির পরিসংখ্যানও দুর্দান্ত তবে প্রায় সব মাপকাঠিতেই তিনি গারনারের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে আছেন।

লিস্টের পরবর্তী দুইজন হ্যাডলির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী – ইমরান খান ও কপিল দেব। দুজনেই বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক, দুজনেই টেস্ট এবং একদিনের ক্রিকেট – দুটোতেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউণ্ডার। দুজনেরই সময়কাল ১৯৮৭।

টেস্টের তুলনায় অবশ্য ইমরানের একদিনের বোলিং পরিসংখ্যান একটু ম্যাড়ম্যাড়ে। ১৭৫ ম্যাচ খেলে ১৮২ উইকেট নিয়েছেন ইমরান, গড় ২৬.৬২। ইকনমি রেট ৩.৯। ইমরানের ম্যাচপ্রতি উইকেট কম হওয়ার একটা কারণ অবশ্য এটা যে তিনি বেশ কিছু ম্যাচ শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন।

কপিলের সংখ্যাও প্রায় ইমরানের কাছাকাছি। ২২৫ ম্যাচে মোট ২৫৩ উইকেট নিয়েছেন কপিল, উইকেট প্রতি ২৭.৪৫ রান দিয়ে। কপিলের ইকনমি অবশ্য ইমরানের চেয়ে একটু বেটার, ৩.৭।

ইমরান ও কপিল দুজনেই আইসিসির সর্বকালের লিস্টে গার্নার – হ্যাডলির চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে। কপিলের সর্বাধিক পয়েন্ট ৮৪৫, ইমরানের ৭৮০। যেখানে গার্নার চার বছর এবং হ্যাডলি ছয় বছর আইসিসির র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে ছিলেন, সেখানে ইমরান আর কপিলের সেই সংখ্যা যথাক্রমে শুন্য এবং এক।

সুতরাং প্রথম চারজনের মধ্যে গার্নারকে সেরা হিসেবে বেছে নিতে খুব একটা অসুবিধে নেই। শুধুমাত্র একটা তথ্য গারনারের বিপক্ষে যাবে – শুরুর দিকে একদিনের ম্যাচ কম খেলা হওয়ায় তার নেওয়া উইকেটের সংখ্যা অন্যান্য আলোচ্য বোলারদের চেয়ে কম। তবে এর জন্যে গারনারকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। বরং আরও বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে তিনি যে আরও কিছু রেকর্ডের অধিকারী হতেন সেটাও অনুমান করা কঠিন নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link