সময়টা ১৯৫৩। হাঙ্গেরির তখন ফুটবলে সোনার যুগ। গুস্তাভ সেবেসের কোচিং-এ হিদেকুটি-পুসকাস-ককশিশ সহ সোনার টিম দুনিয়া মাতিয়ে রেখেছে ফুটবলের অভিনব ২-৩-৩-২ ফরমেশনে। বিশ্বজোড়া ফুটবল সুখ্যাতি হাঙ্গেরির। ইতোমধ্যে অলিম্পিক গোল্ডও জিতে নিয়েছে।
ওদিকে ইংরেজদের ফুটবল ছিলো কনজারভেটিভ, স্টেরিও টাইপ। ত্রিশ বছর আগে হারবার্ট চাপম্যানের রেখে যাওয়া ‘W-M’ ফরমেশন থেকে তারা বেরোতে পারেনি। অবশ্য এই না বেরোতে পারার একটা কারণও ছিলো। ইংরেজরা চিরকালই আত্ম-অহংকারী একটা জাতি। সারাজীবন ধরে নিজেদের ফুটবলের আবিষ্কারক বা স্রষ্টা বলে দাবি করে এসেছে, অথচ এর কোনো প্রমাণ নেই, এমনকি আজও ফিফা ইংরেজদের ফুটবল স্রষ্টা হিসাবে কোনো স্বীকৃতিই দেয়নি।
ইংরেজরা মনে করতো ইংল্যান্ডের বাইরে তেমন মানের ফুটবল খেলা হয়না,তারাই ফুটবল শ্রেষ্ঠ।নিজেদের অধিকৃত উপনিবেশ গুলি ছাড়া তারা কোথাও ফুটবল খেলতেও যেতো না। তারা তাঁদের নিজেদের ফুটবল ফেডারেশন এফএ ছাড়া কাউকে মানতও না, এমনকি ফিফাকেও নয়। ফিফা’র সংগঠন ছিলো ফরাসিদের মস্তিষ্কপ্রসূত, তাই ইংরেজরা ১৯৫০ অবধি ফিফাকে মান্যতা দেয়নি,এমনকি ১৯৫০ এর আগের বিশ্বকাপ গুলোতে খেলতেও যায়নি, কারণ তাঁরা ভাবতো তাদের খেলাই শ্রেষ্ঠ, কি হবে ওসব জুলে রিমে খেলে।
ঠিক একইভাবে, ফরাসিদের মস্তিস্কপ্রসূত ইউরোপিয়ানস্ কাপ বা এখনকার চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতেও তাদের আপত্তি ছিলো। এই সকল কারণে, ইংরেজরা ইংল্যান্ডের বাইরের ফুটবল থেকে হয়ে গিয়েছিলো বহির্মুখী।তাই ১৯২৫ এর দিকে আর্সেনালের হারবার্ট চাপম্যানের তৈরি করে যাওয়া ‘W-M’ ফরমেশন বা ৩-৪-৩ ফরমেশন থেকে তারা তখনও বের হতে পারেনি, অথচ ফুটবল তখন অনেক এগিয়ে গেছে।
আর শুধু নিজেদের উপনিবেশগুলিতে ফুটবল খেলার দরুণ ১৯৪৯ থেকে তারা একটি মাত্র ম্যাচ হেরেছিলো,এটা তাদের অহংকারকে আরও উঁচুতে তুলে দিয়েছিল। তো ফিরে আসি ১৯৫৩ এর কথায়। এহেন আত্মহংকারী ইংল্যান্ড মানতে চাইলোনা হাঙ্গেরির শ্রেষ্ঠত্বের কথা। তাঁরা মনে মনে বললো, ‘ওহে হাঙ্গেরি, এসো, আগে হারিয়ে যাও আমাদের ওয়েম্বলিতে, তবে না হয় মানবো তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব।’
ম্যাচ হলো। ওয়েম্বলিতে গেলো গুস্তাভ সেবেসের হাঙ্গেরি দল। ব্রিটিশ মিডিয়া ম্যাচটাকে নাম দিলো –‘ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি।’হাঙ্গেরির আধুনিকতা বনাম ব্রিটিশদের মান্ধাতা ফুটবল–কে জিতবে? ব্রিটিশরা দল নামালো ৩-৪-৩ এর ডব্লিউ-এম ফরমেশনে। আর হাঙ্গেরি দল নামালো ২-৩-৩-২ ফরমেশনে।
ডব্লিউ এম-এ সেন্টার হাফ বিপক্ষের নাম্বার নাইনকে মার্ক করতো। হাঙ্গেরি টিমে নয় নম্বর জার্সি পড়ত হিদেকুটি। হিসাবমতো ইংরেজ সেন্টার হাফ দায়িত্ব নিলো তাঁর। কিন্তু সে বেচারা বুঝতে পারলো না গুস্তাভ সেবেসের চাল। হিদেকুটি নাম্বার নাইন হলেও খেলতো অনেক ডিপ থেকে,মিডফিল্ডার হিসাবে।আদতে সে ছিলো ডিপ লাইয়িং ফরোয়ার্ড।
ইংরেজ সেন্টার হাফ শুধু হিদেকুটিকে মার্ক করেছিলো ওকে স্ট্রাইকার ভেবে। কিন্তু হাঙ্গেরি দলের আসল স্ট্রাইকার ছিলো ককশিস আর পুসকাস,যাদের জার্সি নাম্বার ছিলো যথাক্রমে ৮ আর ১০। তাই বারবার,হিদেকুটি ইংরেজ সেন্টার হাফকে নিজের দিকে টেনে নিলো আর ক্রিয়েট হওয়া স্পেশে গোল করে গেলো পুসকাস আর ককশিসরা।
খেই হারিয়ে ফেললো ইংল্যান্ড। ব্রিটিশ মিডিয়া অবাক হয়ে গেলো হাঙ্গেরির এই অভিনব ফুটবল দেখে। গুস্তাভ সেবেস হাঙ্গেরির ফুটবলে হিদেকুটিকে দিয়ে আবিস্কার করে গেলো ডিপ লাইয়িং ফরোয়ার্ড পজিশনের,যাকে ষাট বছর পর গোটা বিশ্ব জানবে ফলস্ নাইন হিসাবে, যে পজিশনে লিওনেল মেসিকে খেলিয়ে বিশ্বত্রাস হয়ে উঠবে গুয়ার্দিওলার বার্সেলোনা।
গুস্তাভ সেবেসের ২-৩-৩-২ ছক ছিলো ডাচদের টোটাল ফুটবলের প্রারম্ভিক রূপ। অবশ্যি ডাচদের টোটাল ফুটবলের অনেকগুলো কারণ ছিলো,শুধু রেনেস মিশেল বা ক্রুয়েফই যে নেদারল্যান্ডসে টোটাল ফুটবল নিয়ে আসে তা নয়। ফিরে আসি ১৯৫৩ এর ম্যাচ অফ দ্য সেঞ্চুরিতে। ইংরেজরা হাঙ্গেরির কাছে ম্যাচ হারলো ৩-৬ গোলে। কিন্তু হারলে কি হবে, তাঁদের গুমোট কিছুতেই ভাঙলোনা। তাঁরা দাবি করলো আরেকটা ম্যাচ চাই তাদের, এটা নিছকই অঘটন। ফলমতো, হাঙ্গেরির বুদাপেস্তে খেলতে গেলো ইংল্যান্ড। ম্যাচটা ইংল্যান্ড হারলো ১-৭ গোলে।
এই ঘটনা বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে একটা মোড় হয়ে রয়ে গেলো। একগুঁয়েমি ছেড়ে ব্রিটিশ দলগুলি স্বীকার করলো তাদের উচিত ইংল্যান্ডের বাইরেও বিভিন্ন ইউরোপের দেশগুলিতে খেলতে যাওয়া। সবার প্রথম যে ব্যক্তিটি ইংল্যান্ডের কোনো ক্লাবকে ইউরোপিয়ানস্ কাপে খেলতে নিয়ে যেতে চাইলেন, তিনি হলেন ম্যাট বাসবি, কিছু বছর পর যাঁর নিজের হাতে গড়া ‘বাসবি বেইবস’ নিয়ে বিশ্বে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ ক্লাব হয়ে উঠবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
বাসবির দেখাদেখি অন্যান্য ইংরেজ ক্লাব গুলোও একে একে নাম লেখালো ইউরোপিয়ানস্ কাপে যা আজকের চ্যাম্পিয়নস লিগ। বদ্ধ জানলা খুলে বহুদিনের প্রত্যাশিত হাওয়াটা বয়ে গেলো ইংল্যান্ডে, বইয়ে দিলো হাঙ্গেরি।
এই সেই বুদাপেস্ট, যেখানে আজ স্পেস ক্রিয়েট আর স্পেস ব্লকিং এর অনবদ্য নমুনা দেখিয়ে ফ্রান্সকে নাস্তানাবুদ করলো হাঙ্গেরি। আর এই সেই ফেরেঙ্ক পুসকাস স্টেডিয়াম, যে স্টেডিয়ামের নামাধিকারী হয়তো আজও কবরে শুয়ে স্বপ্ন দেখে তার দেশ একদিন সোনার পরী ঠিক জিতে নেবে, যেটা একটুর জন্য হয়নি, ৫৪’র জার্মানির কাছে হার দিয়ে, হয়নি চোট পেয়ে খেলতে নামা ফেরেঙ্ক পুসকাসের অনবদ্য ফুটবলের পরেও।
সত্যি, আজকের হাঙ্গেরিয়ানদের ভাইকিং ক্ল্যাপ মনে পাড়িয়ে দিল – ‘একটুর জন্য কত কিছুই হয়নি’!