লাতিন শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা ইউরোপের হাতে!

লাতিন ফুটবলের নান্দনিক সৌন্দর্য্য সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ব্রাজিলের রোনালদিনহোর পায়ে। এর পরে আর কোনো খেলোয়াড়কে আমি পাইনি যার খেলায় বা মাঠের উপস্থিতিতে চিরায়ত লাতিন লাবন্য আছে। মূলত ২০০৬ সাল থেকেই ফুটবলের আধিপত্য চলে যেতে শুরু করে করে ইউরোপের হাতে।

লাতিনের ছোট ছোট পাস আর কম গতির ফুটবল মার খেতে শুরু করে ইউরোপের লং পাস আর দুর্দান্ত গতিময় ফুটবলের কাছে। ফলাফল গত ১৯ বছরে বিশ্বকাপ জেতেনি কোনো লাতিন দল। আপনারা অনেকেই এ কালের মেসি,নেইমার বা নিকট অতীতের রিকার্ডো কাকার কথা বলবেন। কিন্তু তাদের সাফল্য মোটাদাগে তাদের ক্লাবের পক্ষে; জাতীয় দলে তাদের উপস্থিতি বড় কোনো সাফল্য এনে দিতে পারেননি।

প্রায় একই সময়ে কোপা আমেরিকা আর ইউরো চলছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কলম্বিয়া বা চিলির ম্যাচগুলোর সাথে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, ডেনমার্ক বা চেক প্রজাতন্ত্রের খেলার তুলনা করুন। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা জয় পেলেও খেলা কি দর্শকদের মন ভরাতে পারছে? অন্যদিকে ইউরোর অধিকাংশ ম্যাচেই হচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই!

সর্বশেষ উদাহরণ ফ্রান্স ও হাঙ্গেরির মধ্যকার ম্যাচটি। হাঙ্গেরির ফুটবলের সেই সোনালি অতীত আর নেই। ১৯৫৪ ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালিস্টরা এখন কেবলই ফেরেঙ্ক পুসকাসের স্মৃতি রোমন্থন করে আক্ষেপ করে। তবে, ইউরোর মূল পর্বে খেলতেই যাদের নাভিশ্বাস অবস্থা ছিল সেই হাঙ্গেরি ১-১ গোলে ড্র করেছে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সাথে।

আবার, ডেনমার্কের সাথে বেলজিয়ামের জয়ের ধরণটাই দেখেন – ডেনমার্ক হেরেছে মানলাম, কিন্তু তারা বাজে ফুটবল খেলেছে তা নয় বরং বেলজিয়ামের ডি ব্রুইনা, এডেন হ্যাজার্ড দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমে ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকা ম্যাচটি কি অসাধারণ নৈপুণ্যে ২-১ গোলে জিতে নিলো!

এর আগে নেদারল্যান্ডস বনাম ইউক্রেন ম্যাচ কি টানটান উত্তেজনায় শেষ হলো! গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের ৫২ ও ৫৮ মিনিটে ২ গোলে এগিয়ে যায় হল্যান্ড। এর কিছুক্ষণ পরেই ৭৫ মিনিটে ডি বক্সের বাইরে থেকে চোখ ধাধানো শটে অনবদ্য এক গোল দিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভাব আন্দ্রে ইয়ারমোলেঙ্কোর।

প্রথম গোল দেয়ার চার মিনিটের মধ্যেই আবার রোমান ইয়ারেমচুক দারুন এক হেডে মাত্র ৪ মিনিট আগেও ২-০ গোলে পিছিয়ে খেলায় ২-২ সমতা নিয়ে আসেন। এরপর মাত্র ৬ মিনিট অতিবাহিত হতে না হতেই ডেঞ্জেল ডামফ্রিসের গোলের সুবাদে ৩-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে হল্যান্ড। ৫২ মিনিট থেকে ৭৯ মিনিট এই ২৭ মিনিট সময়ের মধ্যে গোল হয়েছে পাঁচটি। বিষয়টি মোটেই এমন নয় যে কোনো দলের রক্ষণ খুব বড় ভুল করেছে। বরং ফরোয়ার্ড খোলোয়াড়দের মুহু মুহু আক্রমণ আর নৈপুণ্যই খেলাটি জমিয়ে তোলে।

ফুটবলের বৈশ্বিক আসর গুলোতে ইউরোপের আধিপত্যের আরেকটি কারন আছে৷ সেটা হলো লাতিন দলগুলোর জয়-পরাজয় বেশিরভাগ সময়ই একজন বা দুইজন খেলোয়াড়ের পারফরমেন্সের উপর নির্ভর করে, আর ইউরোপের ফুটবল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলগত। আপনারা একটু মেসি বিহীন আর্জেন্টিনা বা নেইমার বিহীন ব্রাজিলের কথা চিন্তা করুন তো!

এই দুই খেলোয়াড় অনুপস্থিত থাকলে দুটো দলই সমশক্তির দলের কাছে মুখ থুবড়ে পরে নাস্তানাবুদ হবে বলেই আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে এমবাপ্পেকে ছাড়া ফ্রান্স, এডেন হ্যাজার্ডকে ছাড়া বেলজিয়াম, ক্রিয়ো ইমোবিলকে ছাড়াও ইতালি বিশ্বের যে কোনো দলের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। ইউরোপের টিমগুলোর গতি, লংপাস, দলগত খেলা এই দিকগুলোর কারনে নিকট ভবিষ্যতেও ফুটবলের বৈশ্বিক আসর গুলোতে ইউরোপের রাজত্ব কায়েম থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।

লাতিন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব কয়েকটা দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ও কালেভদ্রে চিলি ছাড়া সেখানে আর কেউই মূল শিরোপার আলোচনায় আসতে পারে না। এমনকি গ্রুপ পর্যায়ের অধিকাংশ ম্যাচই দেখা যাচ্ছে একতরফা। ফলে, পার্থক্যটা স্পষ্ট। সমস্যাটা একটু গভীর, লাতিন কোচদের চেয়ে ইউরোপিয়ান কোচরা অনেক এগিয়ে এখন। লাতিন কোচরা নিজেদের পরিচিত গণ্ডির বাইরেই যেতে পারছেন না। অন্যদিকে, ইউরোপিয়ান কোচরা সব দিক থেকেই এখন বিশ্বমানের। সেই ফলটা মাঠেই দেখা যাচ্ছে।

সর্বশেষ লাতিন দল হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিল। সেটাও ২০০২ সালে। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত আর মাত্র একবারই লাতিন কোনো দল ফাইনাল খেলতে পেরেছে। এর বাইরে সবগুলোতেই ফাইনালে ছিল ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব। চারটি বিশ্বকাপই জিতেছে ইউরোপিয়ান কোনো দেশ। ফলে, বলে দেয়াই যায় – লাতিন শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা এখন ইউরোপের হাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link