স্বপ্নের সাথে বাঁচা রুমী

তাঁর বাবা ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। তিনিও চাকরি করেছেন বাংলাদেশ বিমানে।

এই মানুষটিই ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের একেবারে শুরুর দিকের সৈনিক। আবার বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এই মানুষাটার হাত ধরেই। এছাড়া নিয়মিত বই লেখা, ছবি আঁকা, প্রত্নতত্ব নিয়ে গবেষণা সবই করে যাচ্ছেন একাধারে। বাংলাদেশের ক্রিকেট কিংবা ব্যান্ড সংগীতে তাঁর ভূমিকা ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনুপ্রেরণার নাম।

তিনি এক ও অদ্বিতীয় ওমর খালিদ রুমী। এই সব্যসাচী মানুষটি যেনো নতুন প্রজন্মকে এখনো বলে যাচ্ছেন, ‘তোমার স্বপ্নের পেছনে ছোটো।’

১৯৫০ সালে জন্ম নেয়া রুমী এখনো দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠা কিংবা নিজের স্বপ্নের পিছনে গোটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটাই শিখিয়েছেন তিনি। একজন অলরাউন্ডার হিসেবে ১৯৭৯ ও ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের প্রথম দুই আইসিসি ট্রফির দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। রুমী ছিলেন একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং লেগ স্পিনার। তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেটে আসা প্রথম পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার।

সেই সময় তিনি বাংলাদেশ বিমানের হয়েও চাকরি করতেন। ভোর তিনটায় উঠে আবাহনী মাঠে চলে যেতেন ক্রিকেট অনুশীলন করতে। তারপর সারাদিন চাকরি করে আবার রাতে তাঁর ব্যান্ড দল নিয়ে গানের চর্চা করতেন। তিনটি কাজই সমানতালে করে যাচ্ছিলেন সত্যিকারের এই অলরাউন্ডার।

১৯৭৯ সালে আইসিসি ট্রফির প্রথম ম্যাচেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন রুমী। ফিজির বিপক্ষে সেই ম্যাচটিই ছিল দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃত ম্যাচ। অচেনা কন্ডিশনে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল মূল্যবান ২৮ টি রান। তবে দল হিসেবে ১৯৮২ সালের আইসিসি ট্রফিতে বেশি সফল ছিল বাংলাদেশ।

১৯৮২ সালে আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। সেবারও অলরাউন্ড পারফর্মেন্স করে ভূমিকা রেখেছিলেন ওমর খালেদ রুমি। সেই আসরে ৭ ম্যাচে ব্যাট হাতে ১৫১ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। দুই আইসিসি ট্রফি মিলে রুমির ঝুলিতে ছিল ১৯৫ রান ও ৮ উইকেট।

ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটেও অসাধারণ সফল ছিলেন এই অলরাউন্ডার। আবাহনী ও বিমানের হয়ে তাঁর ঢাকার ক্রিকেটে সেঞ্চুরি ও ৮ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে তাঁর। সেই সময়ের শক্তিশালি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে দারুণ সব পারফর্মেন্স রয়েছে এই অলরাউন্ডারের। আবার ১৯৭৮ সালে যখন হায়দ্রাবাদ ব্লুজ বাংলাদেশে খেলতে এসেছিল তখন আংশুমান গায়কড় ও রজার বিনির উইকেট নিয়েছিলেন এই লেগি।

তবে ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পর ক্রিকেট থেকে আস্তে আস্তে সড়ে আসেন রুমি। সেই সময় তিনি তাঁর চাকরি ও গানেই বেশি মনোযোগ দিতে চাচ্ছিলেন। ফলে ১৯৮৬ সালের আইসিসি ট্রফিও খেলতে যাননি আগের দুই আসরের সফল এই ক্রিকেটার।

যদিও ছোটবেলা থেকে গানের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে একটি ব্যান্ডের গান শুনে গিটার কেনার বায়না ধরেন রুমি। পরে অনেক সময় নিয়ে হলেও নিজে নিজেই গিটার বাজানো শিখেন তিনি। ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম রক ব্যান্ড আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভার্স। সেই সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই ব্যান্ডটি। যদিও তাঁরা মূলত পশ্চিমা গানেরই কাভার করতো।

ঢাকা পূর্বানি হোটেলে তাঁরা তাঁদের প্রথম কনসার্টটি করেছিল। সেই সময় যেহেতু খুব বেশি ব্যান্ড ছিল না এবং কনসার্ট গুলো ইনডোরেই হতো ফলে সেগুলো বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো ঢাকার মানুষের কাছে। একটা যুদ্ধবিধবস্ত দেশের সাংস্কৃতি গড়ে উঠার পিছেও বড় ভূমিকা ছিল রুমীদের।

ফলে সেই সময় ঢাকার সব বড় বড় হোটেল গুলোতে কনসার্ট করতো রুমির দল। ক্লাব ক্রিকেটে কিংবা দেশের বাইরে সফরে গেলেও রুমির গিটারে মেতে উঠতো দল। বিদেশি অনেক ক্রিকেটারও সেই সময় রুমীকে প্রসংশায় ভাসিয়েছিলেন।

১৯৭৭ সালে তিনি ব্যান্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর পর সেই ব্যান্ডে তাঁর মেয়ে ফারিবা ওমরও যুক্ত হয়েছিলেন। পপ ও রক মিউজের জন্য বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল এই ব্যান্ডটিও। সেই সময় আর্মি স্টেডিয়ামে ২০-৩০ হাজার দর্শকের সামনে কনসার্ট করতেন তাঁরা।

সবমিলিয়ে ক্রিকেট, শিল্প, গান ও বইয়ে সমৃদ্ধ এক মানুষ ছিলেন ওমর খালেদ রুমি। তাঁর স্ত্রী রোকেয়া সুলতানাও ছিলেন একজন পুরোদস্তুর চিত্রকর। ফলে তাঁদের দুজনেরই আলাদা আলাদা স্টুডিও ছিল। ওরকম একটা পরিবেশে বেড়ে উঠার কথা মনে পড়লে এখনো রোমাঞ্চিত হন তাঁদের মেয়ে ফারিবা।

এই বয়সে এসেও একইরকম কর্মব্যস্ত রুমি। ক্রিকইনফোকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রুমি বলছিলেন,’ গত ত্রিশ বছর ধরেই আমি প্রতিদিন সকালে উঠে কয়েক ঘন্টা পড়ি এবং লিখি। তারপর একটু ব্যায়াম করে এসে ছবি আঁকতে বসি।’

এরপরেও সময় করে ক্রিকেট খেলা দেখেন রুমি। সাংস্কৃতিক নানা আয়োজনেও তাঁকে এখনো দেখা যায়।

বেঁচে থাকার জন্য এক জীবন আসলে কী ভীষণ ছোট। তবুও জীবনের নানা চাহিদায় আমরা এক জীবনও ঠিক করে বাঁচি না। এ যেনো মৃত্যুর আগেই বারবার মরে যাওয়া। তবে রুমিরা সেই পথে হাঁটেন না। তাঁদের কাছে নিজের ভালোবাসার জায়গায় বেঁচে থাকাই জীবনের একমাত্র চাহিদা। রুমিরাই সত্যিকার অর্থে  একটা জীবন বাঁচেন, আমাদেরও বাঁচার তাগিদ দিয়ে যান।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link