২০১৩ এর মে মাস। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ঘটে যাওয়া স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে ভারত তথা বিশ্বক্রিকেটে তখন তুমুল আলোড়ন। মানুষের মন যখন আবার চলে যাচ্ছে সেই ২০০০ সালের সময়কার দিনগুলিতে, যখন বেটিং কাণ্ডে জর্জরিত ছিল ক্রিকেট, মানুষের মনে বিশ্বাস চলে গিয়েছিলো।
সেই সময় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলো এক দামাল বাঙালি নেতার সাথে একঝাঁক তরুণ, ঠিক তেমনি এ দেশের ক্রিকেটে আবার মাহেন্দ্রক্ষণ আনার জন্য হাজির এক মহেন্দ্র সিং ধোনি। তিনিই পারেন প্রায় বিস্মৃত হতে বসা জনৈক শিখর ধাওয়ানকে নিজের গিয়ারে চলার লাইসেন্স দিতে। তিনিই পারেন রোহিত শর্মা নামক এক তরুণের ক্যারিয়ার নিয়ে যখন টানাটানি তাকে ওপেনিংয়ে তুলে অক্সিজেন জোগাতে। আবার তিনিই পারেন ইশান্ত শর্মা নামক এক ঘোড়াকে দিয়ে ফাইনালে বিপক্ষের মুখ থেকে ম্যাচটা কেড়ে আনতে। তাঁর হাতেই তো শোভা পায় বিশ্বের সবকটা ট্রফি, কপালে যদি মাহেন্দ্রযোগ চলে।
গা গরমের ম্যাচে লঙ্কা আর অজিদের দুরমুশ করে বার্তা টা আগে থেকেই দিয়ে রেখেছিলো ভারত, অসিদের তো আবার ৬৫ রানেই শেষ করে নিজেদের বোলিং শক্তি ঝালিয়ে নেয়। আসল টুর্নামেন্ট শুরু হতেই ধাওয়ান ধামাকা চালু। ২০১০ সালে অভিষেকের পরে মাত্র কয়েকটা ওয়ান ডে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল ধাওয়ানের, কিন্তু তিনি যে লম্বা রেসের ঘোড়া।
আর টুর্নামেন্ট শুরু হতেই ধাওয়ানের পুরো তোপ গিয়ে পড়লো ম্যান্ডেলার দেশের ওপর, আর যাই হোক খেলার মাঠে তো তিনি কোনো গান্ধীগিরিতে নেই। গোঁফ মুচড়িয়ে ধাওয়ানের সেলিব্রেশনটা সেবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটা প্রতীকী হয়ে গেল। ধাওয়ান, রোহিতের ব্যাটে দক্ষিণ আফ্রিকা জয় করে সামনে ক্যারিবিয়ান রা তখন।
আগের বছরই কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে চমকে দিয়েছে তাঁরা, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও চমক দেওয়ার পালা। কিন্তু কোনো এক রবির জালে যে নিজেরাই চমকে যাবে তা বোধহয় তারা ভাবেনি, হ্যাঁ রবীন্দ্র জাদেজাই সেদিন ক্যারিবিয়ান সংহারক পাঁচটি উইকেট নিয়ে, সাথে থাকলো ‘গাব্বার’ ধাওয়ানের আরেকটি শতক। সেমি ফাইনালের টিকেট প্রায় হাতে ভারতের।
এরপরই সেই বহুকাঙ্খিত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত – পাক যুদ্ধ। মিসবাহ উল হকের পাকিস্তান পরের ম্যাচে ভারতকে সামনে পেয়ে বদলা টদলা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু এজবাস্টনের দুপুরে বরুণ দেবের কল্যানে ভিজে পিচে ভূবন ভোলানো সুইং বোলিংয়ে পাক দলকে ব্যাট বগলে আশা যাওয়ার পথ দেখালেন ভূবনেশ্বর কুমাররা। ধাওয়ান রা রান তাড়া করতে দেরি করেননি আর, বদলা নেওয়ার অঙ্গীকার দেখানো পাক দলকে লাহোরের টিকিট হাতে ধরিয়ে নিজেরা সেমিফাইনালের টিকিট হাতে নিয়ে কার্ডিফ এর রাস্তা ধরলো ভারত।
ওয়েলসের মাঠ কার্ডিফ, বিখ্যাত গ্লামারগন কাউন্টি দলের মাঠ ও বটে। গ্লামারাস শ্রীলঙ্কা দল কে সেমিফাইনালে সে মাঠে পেলো ভারত। কিন্তু ব্যাটিংয়ে যদি থাকেন কোনো এক রোহিত শর্মা, বোলিংয়ে আছেন কোনো এক ইশান্ত শর্মা, যাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ার ও তখন সংকটের মুখে, তো ইশান্ত শর্মার ক্যারিয়ার কে অক্সিজেন দিতেই লঙ্কার সব ঝাঁজ গেল থেমে। ২০০-এর গন্ডি ও পেরোতে পারলো না লঙ্কাবাহিনী, ধাওয়ান, রোহিত, বিরাটের ব্যাটে আবারো হাসতে হাসতে জিতে ফাইনালে ইংরেজ দের মুখোমুখি ভারত।
১১ বছর আগে লর্ডসের এক বিকালে কোনো এক ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে ইংরেজদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল দামাল সৌরভের ভারত। এবার আর লর্ডস নয়, গন্তব্য বার্মিংহাম। ওয়ার্কউইকশায়ার কাউন্টির মাঠ, ইংরেজদের বেশ পয়া সে মাঠ।
কিন্তু, সকাল থেকেই সেদিন বার্মিংহামের আকাশে কালো মেঘ, বরুণদেবের জন্য ১১ বছর আগেরই একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে জেতা ম্যাচ মাঠে মারা গেছিল, এবারে তখনো খেলা শুরুর ব্যাপারেই তুমুল অনিশ্চয়তা। কিন্তু বরুণদেব একটু প্রসন্ন হতেই ওভার কাটছাঁট করে হইহই করে শুরু হলো খেলা, তবে হয়ে গেল সেটা কুড়ি বিশের ম্যাচ।
ভেজা পিচে ইংল্যান্ডের ‘রবি’ মানে রবি বোপারার মিডিয়াম পেস মারাত্মক হয়ে উঠল, কিন্তু ভারতীয় দলেও রবির অভাব নেই। বিরাট কোহলি ভারতের ‘রবি’ জাদেজাকে সঙ্গে নিয়ে বিপর্যয় সামলে দিলেন, জাদেজার ব্যাট থেকে ২৫ বলে ঝকঝকে ৩৩, আর কোহলির ব্যাট থেকে ৪৩, পরিস্থিতির বিচারে যা শতরানের সমান।
এবার বোলিংয়ের সময়ও ভারতের আকাশে আবার ‘রবি’র উদয়। দুই ‘রবি’ অশ্বিন আর জাদেজা দিলেন ইংরেজ ব্যাটিং কে উপড়ে, পাশে পেলেন ‘অশান্ত’ ইশান্ত শর্মা কে। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো আবার ও ৫ রানে ফাইনাল জয় ভারতের। দেশের ক্রিকেটের ফিক্সিং কেলেঙ্কারি কাণ্ডে উত্তাল অবস্থায় এ জয় ভারতীয় ক্রিকেট কে অক্সিজেন দিলো আর মানুষের বিশ্বাসটাকেও ফিরিয়ে আনলো।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ইংলিশ কন্ডিশনে সুইং না খেলতে পারার যাবতীয় ধারণাকে নস্যাৎ করে ইংরেজ দম্ভ, অস্ট্রেলিয়ান যুগ কে শেষ করার অঙ্গীকার দেখিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত বিশ্বক্রিকেট মঞ্চে ভারতীয় আধিপত্য কায়েম রাখল। ওই যে বলে মাহেন্দ্রযোগ যদি থাকে তাহলে তাকে খণ্ডাবে কে!