হকি থেকে ক্রিকেট: এক চ্যাম্পিয়নের গল্প

অথচ হকির সেই গোলকিপারই আবার জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। দেশটির প্রথম টেস্ট ম্যাচের অধিনায়ক। এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের সর্বোচ্চ ইনিংস তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছে। অথচ ডেভ হটনের হওয়ার কথা ছিল শুধুই সাধারণ একজন পুলিশম্যান।

পাকিস্তান হকি দলের এক অধিনায়ক একবার বলেছিলেন, ’আমরা কখনো তাঁর মানের গোলকিপার আর দেখিনি।’

অথচ হকির সেই গোলকিপারই আবার জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। দেশটির প্রথম টেস্ট ম্যাচের অধিনায়ক। এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের সর্বোচ্চ ইনিংস তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছে। অথচ ডেভ হটনের হওয়ার কথা ছিল শুধুই সাধারণ একজন পুলিশম্যান।

জিম্বাবুয়েতে তখন খেলাধুলার প্রতি বেশ জোর দেয়া হতো। স্কুলের সব বাচ্চাদেরই অন্তর দুইটি খেলায় অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক ছিল। হটন অবশ্য খেলাটাকে ভালোবেসেই খেলতেন। তবে তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বল স্পোর্টস। ফলে টেনিস, স্কোয়াশ, হকি, ক্রিকেট এই সবগুলোতেই নাম লিখিয়ে ফেলেন তিনি। তবে এরমধ্যে হকিই ছিল তাঁর পছন্দের শীর্ষে।

এরমধ্যে স্কুল শেষ করেই পরিবারের হাল ধরতে তিনি চাকরি নিয়েছিলেন পুলিশে। তবে সেই সময়েও হকিটা নিয়মিত খেলেন । একসময় জাতীয় দলের গোলরক্ষক হিসেবেও সুযোগ পেলেন। খুব দ্রুতই হকির গোলরক্ষক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন হটন। তবে হটনের পরিবারের অবস্থা তখন খুব একটা ভালো না। ফলে তিনি ভাবলেন ক্রিকেটই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে তিনি পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারেন।

সেই থেকেই শুরু হলো হটনের নতুন করে ক্রিকেট যাত্রা। ২৬ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় এই কিপার ব্যাটসম্যানের। এরপর জিম্বাবুয়ে দলের ওয়ানডে অধিনায়কও হন তিনি। ১৯৯২ সালে দেশটি যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পায় তখন হটনকেই টেস্ট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলে ১৯৯২ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক ছিলেন সাবেক এই হকি কিপার।

ভারতের জিম্বাবুয়ের অভিষেক টেস্টেই রীতিমত রেকর্ড করে বসেন এই ব্যাটসম্যান। ৩৫ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের, দেশের ও অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই খেলেন ১২১ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস। সেই সময়ের তরুণ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে নিয়ে তাঁর ১৬৫ রানের জুটি অনেক সমালোচনার জবাব দিয়েছিল সেদিন। জিম্বাবুয়ে যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার যোগ্য সেটাও প্রমাণ করেছিলেন এই দুই ব্যাটসম্যান।

তাঁদের সেই জুটিতে প্রথম ইনিংসে ১৪৯ রানের লিড পেয়েছিল জিম্বাবুয়ে। মোহম্মদ আজহারউদ্দীনের নেতৃত্বে শক্তিশালি ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম টেস্ট ম্যাচেই ড্র করতে পেরেছিল জিম্বাবুয়ে। ফলে নিজেদের টেস্ট ক্রিকেটে বেশ ভালো একটা শুরু এনে দিয়েছিলেন তাঁদের অধিনায়ক।

এর আগে ১৯৮৩ সালে জিম্বাবুয়ের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচেও ছিলেন হটন। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষিক্ত ১১ ক্রিকেটারের মধ্যে একজন তিনি। সেই বিশ্বকাপেও ৬ ম্যাচ খেলে ২টি হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন এই ব্যাটসম্যান। তবে নিজের সেরাটা রেখে দিয়েছিলেন পরের বিশ্বকাপের জন্য। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৩৭ বলে ১৪২ রানের এক ইনিংস। শক্তিশালি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন একাই লড়ে গিয়েছিলেন এই ব্যাটসম্যান।

ওয়ানডে ক্রিকেটে আক্রমনাত্মক ব্যাটিং করার জন্যই পরিচিত ছিলেন হটন। তবে টেস্ট ক্রিকেটে খুব সুন্দর ভাবে নিজের গিয়ার চেঞ্জ করতে পারতেন এই ব্যাটসম্যান। ১৯৯৪ সালে বুলাওয়েতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর টেস্ট স্কিলের প্রমাণ দিয়েছিলেন হটন। প্রায় ১১ ঘন্টা ক্রিজে থেকে খেলেছিলেন ২৬৬ রানের বিশাল এক ইনিংস। এটিই এখন পর্যন্ত কোনো জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংস।

জিম্বাবুয়ের প্রথম টেস্ট জয়েরও সাক্ষী দেশটি সাবেক এই অধিনায়ক। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার তিন বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট জয় পায় জিম্বাবুয়ে। হারারেতে ফ্লাওয়ার্স ব্রাদার্সের ব্যাটে চড়ে প্রথম ইনিংসেই ৫৪৪ রানের বিশাল সংগ্রহ করে দলটি। জবাবে পাকিস্তান গুটিয়ে যায় ২২২ ও ১৫৮ রানেই। ফলে ইনিংস ও ৬৪ রানের বিশাল জয় পায় হটনের জিম্বাবুয়ে।

জিম্বাবুয়ের হয়ে ১৫ বছর ক্রিকেট খেলা হটন ছিলে দেশটির ক্রিকেটের প্রথম তারকা। দেশটির হয়ে খেলেছেন মোট  ২২ টেস্ট ও ৬৩ ওয়ানডে। এরমধ্যে ৪ টি টেস্ট ও ১৭ টি ওয়ানডেতে দেশটির অধিনায়ক ছিলেন হটন। ২২ টেস্টে ৪৩.০৫ গড়ে করেছিলেন ১৪৬৪ রান।

মাত্র ২৪ টেস্ট ইনিংসেই নিজের ১০০০ টেস্ট রান পূর্ণ করেছিলেন ডেভ হটন, যা এখনো জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের দ্রুততম রান। এছাড়া ওয়ানডে ক্রিকেটেও তাঁর ঝুলিতে আছে ১৫৩০ রান। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ছিলেন তিনি।

জিম্বাবুয়ের কিংবদন্তি এই ক্রিকেটার ১৯৯৭ সালের অবসরের পর একটি দলের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিলেন। তারপর আবার ফিরে আসেন জিম্বাবুয়ের হেড কোচ হিসেবে। তাঁর সময়ে দারুন একটি টেস্ট দল গঠন করতে পেরেছিল জিম্বাবুয়ে। কোচ হিসেবে ক্রিকেটারদেরও অনেক পছন্দের ছিলেন তিনি। এখনো দেশটির অনেক তরুণ ক্রিকেটার তাঁকে মেনটর মনে করে।

সবমিলিয়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের জন্য এক নিবেদিত প্রাণ ছিলেন হটন। ১৯৯৮ সালে বুলাওয়ে থেকে হেঁটে হারারে গিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অনুদানের জন্য। তাঁর সাথে অনেক সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছিল সেই যাত্রায়। ২২ দিনের ৪০০ কিলোমিটারের সেই পথযাত্রায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের জন্য ৪০ হাজার ডলার তুলেছিলেন দেশটির সাবেক এই অধিনায়ক।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link