আজো তিনি ইউক্রেনের প্রাণভোমরা

গোল করার পর কাউকে আক্ষেপ করতে শুনেছেন কখনো? সুইডেনের ভিক্টর ক্লায়েসন বোধহয় পোল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪ মিনিটে করা গোলের জন্য কপাল চাপড়াচ্ছেন। তার ওই গোলের ফলেই যে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার সুযোগ পায় ইউক্রেন। সেই ইউক্রেনই অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে গোল করে বিদায় করে দিল ক্লায়েসনের সুইডেনকে। গ্লাসগোর হ্যাম্পডেন পার্কে জমজমাট এক লড়াই শেষে সবাই যখন টাইব্রেকারের অপেক্ষা করছে ঠিক তখনি ১১৯ মিনিটে জাতীয় দলে নিজের অভিষেক গোল করে ইউক্রেনকে উল্লাসে ভাসান ডোভবেক।

এবারের ইউরোতে পরাশক্তিদের বিদায় দেখেছে পুরো বিশ্ব। জমজমাট সব ম্যাচ উপহার দিয়েছে দলগুলো। বহু নাটকের পর বিদায় নিয়েছে পর্তুগাল, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের মতো পরাশক্তিরা। দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে ইউক্রেন-সুইডেনের ম্যাচে তাই নজর ছিল না খুব বেশি দর্শকের। কিন্তু এ রাউন্ডের শেষটাও হলো মনে রাখার মতো এক ম্যাচ দিয়েই।

ফুটবল পরাশক্তিদের তালিকায় কখনোই ইউক্রেন ছিল না। তাঁদের দলের সবচেয়ে বড় তারকা তাদের কোচ আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। বুটজোড়া তুলে রেখেছেন বহুআগেই তাতেও ফুটবলবিশ্বে তাঁর আবেদন কমেনি এখনো। স্যুট পরে থাকা ডাগআউটে থাকা শেভচেঙ্কো এখনো ইউক্রেনের মূল ভরসা।

একালের ফুটবল দর্শকদের আসলে শেভচেঙ্কোকে চেনার কথা নয়। এসি মিলানের সাবেক এই কিংবদন্তি ক্লাব ফুটবলের সম্ভাব্য প্রায় সব খেতাবই জিতেছেন। ব্যালন ডি’অর, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, সুপার কাপ, সিরি ‘এ’ শিরোপা, পরে চেলসির হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা – খেলোয়াড়ী জীবনটা তাঁর অর্জনে ঠাঁসা। কিন্তু, কোচিং ক্যারিয়ারটা শূন্য খেন পর্যন্ত।

দায়িত্ব পাবার আগে সবাই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল অনভিজ্ঞ শেভচেঙ্কো কি পারবেন সামলাতে দলকে? ভালো খেলোয়াড় কিন্তু ব্যর্থ কোচের তালিকাটা যে ভীষণ লম্বা। শেভচেঙ্কো তালিকাটা আর বাড়ালেন না, তার অধীনে প্রাণ ফিরে পেল ইউক্রেন। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন আক্রমণাত্নক, গোল করা এবং করানোই ছিল একমাত্র নেশা। সেই মন্ত্রণা দিলেন শিষ্যদের কানেও, ইউক্রেন এখন ইউরোপের সবচেয়ে আক্রমণাত্নক ফুটবল খেলা দলগুলোর একটি। ইউরোর বাছাইপর্বে পর্তুগালকে পেছনে ফেলে শীর্ষে থেকেই খেলতে এসেছে এবারের ইউরো।

ইউরো শুরুর আগে মাঠে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন ওলেক্সান্দর জিনচেঙ্কো। ক্লাব ফুটবলে ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা এই তরুণ পেপ গার্দিওলার অনেক পছন্দের শিষ্য। ক্লাবে বাঁ পাশটা সামলানোর দায়িত্ব থাকে তার। সিটির তারকাবহুল একাদশে হয়তো তাকে আলাদাভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু ইউক্রেনের একাদশে তিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বরং জাতীয় দলে তার দায়িত্বের পরিধিটা আরেকটু বড়, মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বটা যে তার কাঁধে। কিন্তু এত ভরসার প্রতিদান তিনি দিলেন কই, গ্রুপপর্বে রইলেন নিজের ছায়া হয়ে। গোল করা দূরে থাক, ম্যাচে নিজেকে চেনানোর মতো কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু বড় খেলোয়াড়েরা নাকি বড় ম্যাচেই জ্বলে উঠেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে আসার পরই জ্বলে উঠলেন জিনচেঙ্কো, নিজে এক গোল করার পাশাপাশি ভোভবেকের জয়সূচক গোলের ক্রসটাও তারই করা।

জিনচেঙ্কোর পাশাপাশি আরেকজনের কথা না বললে অন্যায় হবে তিনি ইউক্রেন কাপ্তান আন্দ্রে ইয়ারমোলেঙ্কো। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে দুই গোলের পাশাপাশি করেছেন দুই অ্যাসিস্ট। আজকের ম্যাচেও জিনচেঙ্কোর প্রথম গোলের বলটা তিনিই বাড়িয়েছিলেন।

দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে বাদ পড়লেও দারুণ ফুটবল খেলে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে সুইডেন, বিশেষ করে এমিল ফর্সবার্গ। সুইডেনের চার ম্যাচের প্রতিটিতেই গোল করেছেন এই উইংগার। আজকের ম্যাচেও সুইডেনের সমতাসূচক গোলটি আসে তার পা থেকেই।

গোল পেতে পারতেন আরো গোটাখানেক কিন্তু দুবার পোস্টে লেগে ফিরে আসে তার শট। ১১০ মিনিটে ড্যানিয়েলসন লাল কার্ড পেয়ে ১০ জনের দলে পরিণত না হলে হয়তো সুইডেনকে জিতিয়েই ফিরতেন ফর্সবার্গ। কিন্তু কখনো কখনো কেবল ভালো খেললেই হয় না ভাগ্যকেও পাশে পেতে হয়। আজকের ম্যাচে ভাগ্যটাই কেবল পাশে পাননি ফর্সবার্গ, তাই তিনি রইলেন ইউরোর ট্র‍্যাজিক হিরো হয়েই।

শেষ আটে ইউক্রেনের প্রতিপক্ষ সাউথগেটের ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের ‘ইটস কামিং হোম’ থামিয়ে রূপকথার গল্প অব্যাহত রাখতে পারেন কিনা শেভচেঙ্কোর শিষ্যরা সেটার জন্য কেবল সময়ের অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link