প্রতিশোধের রঙে রাঙানো ওয়েম্বলি
৫৫ বছর ধরে এই দিনের অপেক্ষা করেছে ইংল্যান্ডবাসী। একের পর এক নক আউট রাউন্ড গিয়েছে, ম্যাচের পর ম্যাচ গিয়েছে, জার্মানিকে হারের স্বাদ দিতে পারেনি ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের গল্প শুনিয়ে গিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। ’৯৬ ইউরোর টাই-ব্রেকার, ১০ বিশ্বকাপের ল্যাম্পার্ড-কাণ্ড; গল্পগুলো ছিল হতাশার। সেই হতাশার গল্প ভেঙে নতুন আশার গল্প লিখলেন হ্যারি কেন-রাহিম স্টার্লিংরা।
‘Revenge is the dish best served cold’ ইংল্যান্ড সমর্থকদের উল্লাসকে এর থেকে ভালোভাবে আর বোঝানো সম্ভবই নয়। ৫৫ বছরের একটু একটু করে জমতে থাকা ক্ষোভ, দু:খ, আফসোস আর আক্ষেপের প্রতিদান দিলো হ্যারি কেন, রাহিম স্টার্লিংরা।
ইংল্যান্ড-জার্মানির লড়াইটা বহু পুরোনো। অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াইয়ের দামামা যখন আস্তে আস্তে কমে এসেছে, তখনই সেই বারুদে আগুন লাগিয়েছে ফুটবল। রাজনৈতিক যুদ্ধে সামনাসামনি কিছু করতে না পারার ক্ষোভটা দুই দলের সমর্থকেরা মিটিয়েছে ফুটবল মাঠে এসে।
আর নিজেদের মাঠে, নিজেদের দর্শকদের সামনে প্রতিশোধের আগুনে প্রতিপক্ষকে পোড়ানোর মতন আনন্দের আর কী-ই বা হতে পারে?
জার্মানদের সাথে ইংলিশদের সর্বদাই দাঁ-কুমড়ো সম্পর্ক। সেই ১৯৬৬-তে শুরু। শেষ যেবার ফুটবল তার বাড়িতে ফিরেছিল, সেবারের কথা বলছি। জিওফ হার্স্টের সেই গোল এখনও জার্মান-ইংল্যান্ড ম্যাচের হট টপিক। ওয়েম্বলিতে যখন ইংল্যান্ড ম্যাচ এক্সট্রা টাইমে নিয়ে প্রথমবারের মতন উল্লাস করছিল, জার্মানি তখন ছক সাজাচ্ছিল সেই ঘটনার প্রতিশোধের।
দাগ পেরোনোর আগেই গোল ঘোষণা দিয়েছিলেন রেফারি। এরপর থেকে ইংল্যান্ডের সকল দু:খগাথার পেছনে সেই এক ঘটনাকেই দায়ী করে জার্মানরা। আর সে থেকে দু:খগাঁথা লিখবার দায়িত্বও জার্মানরা তুলে নিয়েছিলেন নিজেদের কাঁধে।
১৯৯৬ ইউরোর ক্ষতটা এখনও দগদগে ইংলিশদের গায়ে। সেবার নিজেদের মাটিতে আরেকবার জার্মানিকে হারিয়ে জেতার সুযোগ হয়েছিল ইংলিশদের কাছে। পথটা তৈরিও ছিল। কিন্তু সাডেন ডেথে গিয়ে ভুল করে বসলেন ইংলিশম্যান। আন্দ্রেয়াস কোপকেকে পরাস্ত করতে পারলেন না ইংলিশ ডিফেন্ডার। নিজেদের মাটিতে আক্ষেপ নিয়ে বিদায় নিতে হলো তাঁদের।
একের পর এক ম্যাচ গিয়েছে, হতাশায় দিন শেষ হয়েছে তাদের। টুর্নামেন্টের নক-আউট রাউন্ডে জার্মানির সাথে দেখা হওয়ার অর্থ একটাই। জার্মানদের মুখোমুখি হওয়া মানেও স্বপ্নে বিভোর হওয়া, আর হতাশ হয়ে ফেরত যাওয়া।
এক দুই বছর নয়, গত ৫৫ বছর ধরে একই গল্প, বারবার দেখে যাচ্ছে ইংলিশরা। শেষ দেখা হয়েছিল ১১ বছর আগে, ২০১০ বিশ্বকাপে। নিজেদের ইতিহাসের আরেক সেরা দল নিয়ে নক-আউটে রাউন্ডে উঠেছিল তাঁরা।
ল্যাম্পার্ডের সেই শট জালে পৌঁছেছিল সে কথা অস্বীকার করতে পারবে না কোনো জার্মানও। অথচ রেফারি মানেননি, মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে গিয়েছেন তিনি। ইংলিশ সমর্থকেরা সেদিন অসহায় পরাজয় দেখেছিল জার্মানদের কাছে।
এবারের গল্পটাও একই রকম, জার্মানির মুখোমুখি ইংল্যান্ড। রাউন্ড অফ সিক্সটিন। এবারে ডাগআউটে সেই ডিফেন্ডার। কোচের গেটাপে সেটাপ করলেন দল। ইংল্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল নিয়েই মাঠে নামার প্রতিজ্ঞা তার। অথচ তার কোনোটাই মাঠে দেখা যায় না।
পুরোনো, বোরিং সেটাপ; ম্যাচে নেই কোনো উত্তেজনা। কেউ কেউ তো পারলে এখনই তার কাছ থেক দায়িত্ব নিয়ে অন্যের হাতে সঁপে দেন। কিন্তু তিনি জানেন অপেক্ষা করার মর্ম, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ম্যাচ শেষ করতে না পারার আক্ষেপ তার অনেক দিনের।
ম্যাচের প্রথমে যখন গ্রিলিশ, মাউন্ড, ফোডেন, সাঞ্চোকে ছাড়া ৭ ডিফেন্সিভ মাইন্ডেড খেলোয়াড় নিয়ে নামলেন, তখন এমন একজন ইংলিশ সমর্থকও ছিলেন না, যিনি তার সমালোচনা করেননি। কিন্তু সমালোচনা গায়ে মেখেই বড় হয়েছেন তিনি। গালি শোনাটা তার নিত্যদিনের কর্ম ছিল একসময়।
ওয়েম্বলিতে প্রথমার্ধে কেউই নিজেদের খুঁজে পায়নি। দুই দলই যেন সেইফ গেম খেলছিল। আগেরদিনের মতন এগিয়ে গিয়ে শেষ মুহূর্তে লিড বোটল করার ইচ্ছে কারোর ছিল না। ওয়েম্বলিতে শেষ ১০ ম্যাচ না হারা ইংল্যান্ড যেমন খুব একটা আগায়নি, তেমনই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৫ বছর ধরে না হারা জার্মানতাও খুব একটা এগোয়নি।
ম্যাচ মোটেও ম্যাড়ম্যাড়ে ছিল না, কিন্তু বল জালে প্রবেশ করাতে পারছিল না কোনো দলই। ম্যাচের সুর বদলায় জ্যাক গ্রিলিশের আগমনের পর। নিজের ট্রাম্প কার্ডকে লুকিয়ে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন সাউথগেট। যখন প্রয়োজন পড়লো, তখনই ডেরা থেকে বের করে এনে জার্মানদের মুখের উপর ছুড়ে দিলেন।
৭০ মিনিটে বুকায়ো সাকার পরিবর্তে নামলেন, আর ইংল্যান্ডের খেলা যেন পাল্টে দিলেন মুহূর্তেই। বাম প্রান্ত থেকে বাড়ানো বলে আর ভুল করেননি স্টার্লিং। প্রথমার্ধের ভুলটা শুধরে নিলেন মুহূর্তেই। ৭৫ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড।
চল্লিশ হাজার দর্শকের সামনে ইংল্যান্ডের খেলার ধরণটা সেখানেই যেন পাল্টে গেল। ইংল্যান্ড উজ্জীবিত গোল করে নিজেদের দর্শকদের সামনে, অন্যদিকে গোল পরিশোধ করতে মরিয়া জার্মানি। স্টার্লিং গোল করেছেন আর ইংল্যান্ড হেরেছে, এমন নজির নেই।
হওয়ার সম্ভাবনা জার্মানরা করেছিল বটে। কিন্তু ফিনিশিংটা করতে পারেননি মুলার। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিয়ে ইউরোতে এসেছিলেন মুলার। কিন্তু করতে পারেননি, পিকফোর্ড বাঁধা ভেদ করতে গিয়ে বল পাঠিয়েছেন জালের বাইরে। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা মুলারের ছবিটাই জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে থাকে জার্মানির জন্য। আর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় ওখানেই।
বাকি ছিল শুধু জার্মানির কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার। আর সে কাজটা সিদ্ধহস্তে করলেন অধিনায়ক হ্যারি কেইন। গ্রিলিশের পাস থেকে আর ভুল করেননি কেইন, ঠাণ্ডা মাথায় হেড করে বল জালে জড়িয়েছেন, সেই সাথে ইউরোতে পেয়েছেন প্রথম গোলের দেখা!
বাকিটা সময় একের পর এক ক্রস করে চলেছেন টনি ক্রুস, কোনোটাই পারে ভেড়াতে পারেননি তার সতীর্থরা। রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই অপেক্ষা, আক্ষেপ, ক্ষোভ আর হতাশার সমাপ্তি ঘটলো ওয়েম্বলিতে।
৫৫ বছর আগের ওয়েম্বলি আর আর আজকের ওয়েম্বলি, মিলে মিশে যেন হয়ে গেল এক! ইংলিশদের জার্মান-বধ কাব্য রচনা হলো আরেকবাত, সেই চিরচেনা ওয়েম্বলিতেই। অন্যদিকে ১৯৮-তেই থামলেন জোয়াকিম লো। ইউরোর আগে থেকেই জানিয়েছেন, আর থাকছেন না তিনি।
তবু দলকে নিয়ে অনেকদূর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, ইগো ভেঙে ডেকেছেন পুরোনো সেনানিদের। কোনোতেই কিছু কাজ হয়নি।। কোনোমতে ‘গ্রুপ অফ ডেথ’ পার করে এসে কাটে পরলেন ইংল্যান্ডের কাছে এসেই। ‘গ্রুপ অফ ডেথ’ খ্যাত ‘এফ’ গ্রুপের কেউই আর টিকে থাকলো না দিনশেষে!
ফুটবলকে ‘ঘরে ফেরানো’-র বিশাল দায়িত্ব দিয়ে দলকে ইউরো খেলতে পাঠিয়েছে ইংলিশ মিডিয়া, তাদের হাইপ নিয়ে কম কথাও হয় না। ওয়েম্বলির পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাঁধাটা উৎরে গেল ইংল্যান্ড। সাউথগেটও পূরণ করলেন তার পাপমোচন। সাউথগেট কি পারবেন ফুটবলকে আবারও ঘরে ফেরাতে? প্রশ্নটা এখন সবার সেদিকেই।