ভারতের সেরা ব্যাটিং লাইন আপকে তিনিই শিখিয়েছিলেন কীভাবে একটা দল হয়ে ওঠা যায়। ভারতের ক্রিকেটের দু:সময়ে অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে হাতে হাত রেখে লড়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় কোচ জন রাইট। টানা পাঁচ বছরের মত ছিলেন ভারতের কোচ। যদিও, এসবের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় ব্যাটসম্যান রাইটের কত মহাকাব্য। এই ব্যাটসম্যানের হাত ধরেই আশির দশকে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড।
১৯৭৭ সালে তখন তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে রানের ফুলঝুড়ি ফোটাচ্ছেন। সেই সময়েই নিউজিল্যান্ড দলও খোঁজ চালাচ্ছে একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যানের জন্য। সে বছর সুযোগ না পেলেও ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট সিরিজে দলে ডাক পান জন রাইট। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ওপেনার হিসেবেই তাঁকে মাঠা নামায় নিউজিল্যান্ড। প্রথম টেস্টে খেলতে নেমে রাইটের ব্যাট থেকে এসেছিল ৫৫ রান।
আরেকটু খুলে বলা দরকার। না হলে সেই ৫৫ রানের ইনিংসের মূল্যটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পুরোপুরি বোলারদের জন্য বানানো ইংল্যান্ডের সেই পিচে এই ৫৫ রানই ছিল নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ ইনিংস। তাছাড়া এই ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে এই ৫৫ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন ঠিক ২৪৪ বলে। টেস্টে প্রথম দিনের পুরোটা প্রায় সাড়ে তিনশো মিনিট ক্রিজে আঠার মত আঁটকে থেকে এই ইনিংসটি খেলেছিলেন জন রাইট।
সেই ইনিংসে ভর করেই প্রথম ইনিংসে ২২৮ রান জড়ো করেছিল নিউজিল্যান্ড। ফলে ৪৮ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয় পায় সেই ম্যাচে।
এবং সেই জয়ের নায়ক ছিলেন ওই ম্যাচেই অভিষিক্ত হওয়া তরুণ এক ব্যাটার। নিজের সেই প্রথম ইনিংসেই রাইট দেখিয়েছিলেন তাঁর নিখুঁত ডিফেন্স। নিউজিল্যান্ডও সেদিন পেয়ে গিয়েছিল পরবর্তীর দশকে তাঁদের সেরা ব্যাটসম্যানকে।
নিউজিল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৫০০০ রানের মালিক হন জন রাইট। দেশটির হয়ে ৮২ টি টেস্ট খেলে তিনি করেছিলেন ৫৩৩৪ রান। ভারতের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ১৮৫ রানের একটি ইনিংসও খেলেছিলেন তিনি।
এছাড়া তিনি যতগুলো দলের বিপক্ষে টেস্ট খেলেছিলেন তাঁদের সবার বিপক্ষে অন্তত একটা সেঞ্চুরি আছে এই ব্যাটসম্যানের। সব মিলিয়ে তাঁর সেঞ্চুরির সংখ্যা ছিল ১২ টি। সর্বোপরি আশির দশকে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের যেই উত্থান হয়েছিল তাঁর অন্যতম নায়ক জন রাইট।
১৯৯৩ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও বেশিদিন মাঠের বাইরে থাকতে পারেননি তিনি। ১৯৯৭ সালে কাউন্টি দল কেন্টের হয়ে তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়। ২০০০ সালে রাহুল দ্রাবিড়ও কাউন্টি খেলেছিলেন কেন্টের হয়ে। সে সময় কয়েকবার নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের কোচ হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন জন রাইট। সেই সময়ই তিনি দ্রাবিড়ের কাছে শোনেন ভারতের সিনিয়র ক্রিকেটাররা বিদেশি কোচের জন্য বোর্ডকে চাপ দিচ্ছে।
সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিলেন জন রাইট। ২০০০ সালের শেষ দিকে ধুঁকতে থাকা ভারত দলটার হাল ধরেন তিনি। সেই দলে দারুণ সব ব্যাটসম্যান থাকলেও তাঁদের জিততে শিখিয়েছিলেন মূলত জন রাইটই। তাঁর সাথে ছিল দলটির অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। এই দুইজন মিলে খুব দ্রতই দলটিকে এক সুঁতোয় গেঁথে ফেলেন।
ভারতে এসেই কঠিন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন জন রাইট। সেই সময় ভারতের ক্রিকেটাররা সকালে অনুশীলন করতে নামতো চা-বিস্কুট খেয়ে। প্রথমেই দলের সবার জন্য এই নাস্তা নিষিদ্ধ করেন তিনি। এরপর ফিল্ডিং এ মনোযোগ দেন এই কোচ।
দলের সেরা ব্যাটসম্যানরা সারাক্ষণ ব্যাটিং করলেও ফিল্ডিং কিংবা ফিটনেস নিয়ে বেশ উদাসীন ছিলেন। ফলে আধুনিক ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিল না ভারত। আঙুলে টেপ না পেঁচিয়েই সবাইকে ফিল্ডিং করাতেন তিনি। এমনকি সৌরভ গাঙ্গুলি একবার মাঠে আসতে দেরি করায় তাঁকে নতুন ঘড়ি কিনতে বলেন রাইট।
এইসব আরো ছোট ছোট অনেক পরিবর্তনের ফল খুব দ্রুতই পেতে শুরু করে ভারত। ২০০১ সালে সেই সময়েই অপ্রতিরোধ্য দল অস্ট্রেলিয়ার সাথে টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত। টানা ১৬ টি জয়ের পর ভারতের কাছে টেস্ট ম্যাচ হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেও টেস্ট জয় পায় দলটি।
২০০৩ সালে বিশ বছর পর আবার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে ভারত। ২০০৪ সালে প্রথম বারের মত পাকিস্তানে টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত। সেই বছরই ভারতের হেড কোচের চাকরি ছেড়ে আবার নিজ দেশে ফিরে যান জন রাইট। তবে ভারতের অনেক প্রথম জয় এনে দিয়েছিলেন এই কোচ।
২০০৫ সালে বিশ্ব একাদশের কোচের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। অবশেষে ২০১০ সালে নিজের দেশ নিউজিল্যান্ডের হেড কোচের দায়িত্ব নেন জন রাইট। তাঁর সময়েই ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছিল নিউজিল্যান্ড। এরপর ২০১৩ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের কোচ হয়ে আবার ভারতে আসেন তিনি। সে বছরই প্রথমবারের মত আইপিএলের শিরোপা জেতে মুম্বাই।
দারুণ সফল এই কোচের প্রশংসা করতে গিয়ে শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন, ‘তাঁর সাথে আমার নানা বিষয়ে কথা হতো। সেই ২০০৩ সালে আমাকে বলেছিল যে আমি প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০০ টি সেঞ্চুরি করবো। সেই সময় তাঁর কথায় দারুণ মনোবল পেতাম আমরা। কোচ হিসেবে জন রাইট সত্যিই দারুণ।’