সৌভাগ্যটাই ছুঁতে পারেননি শুধু

২০১৮ সালের ১১ মে। প্রথমবারের মত টেস্ট খেলতে নামে আয়ারল্যান্ড। টেস্ট অভিষেক হয় ১০ আইরিশের।

এক মিনিট, ১০ জন কেন? ১১ জনের কথাটা ‘টেকনিক্যালি’ বলা যাচ্ছে না। কারণ, এদের মধ্যে একজনের টেস্ট অভিষেক আগেই হয়ে গেছে। তিনি হলেন বয়েড র‌্যানকিন, চার বছর আগেই তিনি অ্যাশেজে একটা টেস্ট খেলে ফেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে।

দুই দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন এমন বেশ কয়েকজনের মধ্যে একজন হলেন এই আইরিশ পেসার। ইয়ন মরগ্যান তখন আইরিশ ক্রিকেটকে নিজের অতীত বানিয়ে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের নিয়মিত খেলোয়াড়।

র‍্যানকিনও কাউন্টি ক্রিকেটে নিজের সেরাটা দিচ্ছিলেন ইংলিশদের হয়ে জাতীয় দলে সুযোগের আশায়। আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট তখন আইসিসির সহযোগী দেশের একটি। আইসিসির বিশ্ব আসর ছাড়া বড় দলের সাথে খেলাটা তখন তাদের জন্য ছিলো স্বপ্নের মতো। তাই প্রতিভা দেখানোর সুযোগ খুব কমই থাকতো সহযোগী দেশগুলোর ক্রিকেটারদের।

ইংল্যান্ড ও ওয়ালস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) থেকে করা নিয়মে স্পষ্ট ভাবেই উল্লেখ আছে বৃটিশ এবং আইরিশরা ইংল্যান্ড ক্রিকেটের হয়ে খেলতে পারবে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার অভিজ্ঞতা। এই সুযোগটাই আইরিশদের জন্য যেন সোনার চামচ পাবার মতো।

তবে ইংল্যান্ডের মতো তারকায় ঠাঁসা একটা দলে জায়গা করে নেওয়াটা মোটেও যে সহজ ব্যাপার ছিলো না। তবু আইরিশ ক্রিকেটের তরুন প্রতিভাবান ইয়ন মরগ্যান ঠিক নিজের জায়গাটা পাঁকা করে ফেলেছিলেন ইংলিশদের হয়ে। বয়েড র‍্যানকিনও যেন সে পথেই হাঁটছিলেন।

২০০৭ সালে আয়ারল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে কাউন্টি দল মিডলসেক্সের দ্বিতীয় একাদশে কিছু সময় খেলার পর ডার্বিশায়ারে নাম লেখান র‍্যানকিন। ডার্বিশায়ারের দ্বিতীয় একাদশ থেকে খেলেছেন মূল দলেও।

পরবর্তীতে ২০০৭ এর শেষ দিকে যোগ দেন আরেক কাউন্টি ক্লাব ওয়ারউইকশায়ারে। তবে ইনজুরিতে খুব বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি তিনি। ফিটনেস জটিলতায় ভুগছিলেন বার বার। ইনজুরি আর ফিটনেস ইস্যুতে ক্যারিয়ার নিয়েও বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন এই পেসার।

তবুও কাউন্টিতে তার পেস এবং বাউন্সার জাদু দেখিয়ে ২০১১ সালে ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে শ্রীলঙ্কা এ দলের বিপক্ষে অভিষিক্ত হন তিনি। এরপর ২০১২ সালে ক্রিস ট্রিমলেটের ইনজুরিতে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার সুযোগ এসেছিলো র‍্যানকিনের। কিন্তু ফিটনেস জনিত সমস্যায় দলে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হন তিনি।

ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পেতে ঐ বছরই আইরিশ ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। ততদিনে আয়ারল্যান্ডের হয়ে ৩৭ টি-টোয়েন্টি আর ১৫টি ওয়ানডে খেলে ফেলেছেন তিনি। এরপর নিজেকে ইংলিশ জার্সিতে দেখতে আইরিশ ক্রিকেটের সাথে সম্পর্কটাও ছিন্ন করে ফেলেন তিনি।

র‍্যানকিন জানতেন ফিটনেস ইস্যুতে তার পক্ষে সব ফরম্যাটে খেলা সম্ভব নয়। অবশ্য আয়ারল্যান্ডের হয়ে তার অবসর নেওয়ার আরেকটি বড় কারণ আছে। র‍্যানকিনের ক্লাব কোচ অ্যাশলে গিলস তাকে বলেছিলেন তিনি যদি ইংল্যান্ড এবং ওয়ারউইকশায়ার ছাড়া অন্য কোথাও খেলেন তাহলে কাউন্টিতে তিনি আর খেলার চুক্তি করতে পারবেন না। একদিকে ফিটনেসের সমস্যা তার উপর নিয়মের বেঁড়াজাল! তাই সিদ্ধান্ত নিলেন আইরিশ ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর।

২০১৩ সালের শুরুর দিকে কাউন্টিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে প্রথমবারের মতো র‍্যানকিন জায়গা করে নিলেন ইংল্যান্ডের ওয়ানডে স্কোয়াডে। স্টুয়ার্ট ব্রড এবং স্টিভেন ফিনের ইনজুরিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কপাল খুলে যায়  তাঁর। এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত হলেন র‍্যানকিন।

পরবর্তীতে নিজ দেশ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেই অভিষেক ওয়ানডেতে ৪৬ রানে ৪ উইকেট শিকার করে নজর কাঁড়লেন তিনি। তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তাকে টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নের অ্যাশেজ সিরিজে!

অ্যাশেজ সিরিজে অভিষেক টেস্টেই তাঁর হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর তাঁর দলে থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ইংল্যান্ড দলে খেলার মতো ফিটনেস কিংবা সামর্থ্য তাঁর আছে কিনা সেটা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে  র‍্যানকিন এক গোপন কথা ফাঁস করেন! সেটা হলো তিনি ইনজুরি নিয়েই নাকি ম্যাচ খেলেছিলেন! এই ঘটনা ইসিবি জানার পরই তিনি দল থেকে বাদ পড়েন। এরপর আর ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হয়নি র‍্যানকিনের।

পরবর্তীতে অবশ্য ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে তিনি ডাক পান। সামনেই তখন ২০১৫ বিশ্বকাপ! আইরিশদের তখন বেশ প্রয়োজন ছিল র‍্যানকিনের। বাছাইপর্বে অভিজ্ঞতার বিচারে তাদের সেরা পেসারকে দলে পেতে মরিয়া ছিলো আইরিশরা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে ডাক পাওয়ায় আইরিশরা পরবর্তীতে তাকে পাওয়ার আশাও ছেড়ে দেয়।

কাট টু পাঁচ জুলাই ১৯৮৪।

নর্দান আয়ারল্যান্ডের এক ক্রিকেট পরিবারে জন্ম নেন র‍্যানকিন। পুরো নাম উইলিয়াম বয়েড র‍্যানকিন। ক্রিকেট পরিবার থেকেই উঠে আসা র‍্যানকিনের দুই ভাই এবং বোন প্রত্যেকেই আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের হয়ে খেলেছেন। কৃষি বিষয়ে হারপার অ্যাডামস ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। তখনই তিনি ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে কাজ করেন! তবে পরবর্তীতে বুঝতে পারলেন তাঁর প্রতিভাটা বোলিংয়েই।

র‍্যানকিন অনূর্দ্ধ-১৩ থেকে সব বয়সভিত্তিক দলেই খেলেছেন। তিনটি আন্তর্জাতিক যুব ওয়ানডেতে আইরিশদের হয়ে খেলার সুযোগ পান র‍্যানকিন। আয়ারল্যান্ড এ দলের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেই তিনি জায়গা করেন নেন জাতীয় দলে।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সে আইরিশরা সুপার এইটে জায়গা পায়। ৬ ফিট ৮ ইঞ্চির দীর্ঘদেহীর র‍্যানকিন উচ্চতার কারণে প্রতিনিয়ত বাউন্সারে ব্যাটসম্যানকে বিপাকে ফেলতেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে হারিয়ে সেই টুর্নামেন্টে আইরিশরা বেশ নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স করে। টুর্নামেন্টে ১২ উইকেট শিকার করেন। আইরিশদের সেরা বোলার ছিলেন বয়েড র‍্যানকিন।

এরপর ২০১২ সাল পর্যন্ত আইরিশদের হয়ে খেললেও তার মনে স্বপ্ন ছিলো ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার। তারপর কাউন্টিতে ভাল পারফরম্যান্স দেখালেন। পেয়েও গেলেন ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের টিকেট। পাঠক, এরপরের ঘটনাটা তো ইতিপূর্বেই জেনে গেছেন।

ইনজুরি আর ফিটনেসের কারণে ইংল্যান্ডের হয়ে থিতু হতে পারেননি র‍্যানকিন। এরপর আবারো ২০১৬ সালে পাড়ি জমান স্বদেশে! সেখানে আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুইটি টি-টোয়েন্টির জন্য জাতীয় দলে ডাক পান র‍্যানকিন। তবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য মূল পর্বে যেতে ব্যর্থ হয় আইরিশরা। পরবর্তীতে ওয়ানডে দলেও ডাক পান অভিজ্ঞ বয়েড র‍্যানকিন।

২০১৮ সালে আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচের একাদশে ডাক পান র‍্যানকিন। সেই সাথে ১৫তম ক্রিকেটার হিসেবে দুই দেশের হয়ে টেস্ট খেলার কীর্তি গড়েন তিনি। ২০১৯ সালে ট্রাইনেশন সিরিজে খেলার সময় র‍্যানকিন তার ২০০ আন্তর্জাতিক উইকেট শিকার করেন। এর কিছুদিন পরই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে ক্যারিয়ারের ১০০ ওয়ানডে উইকেট নেন র‍্যানকিন।

একই বছর ২০১৯ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টের জন্য আইরিশ দলে ডাক পান তিনি। সেখানে প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডকে মাত্র ৮৫ রানে অলআউট করে আইরিশরা! যেখানে দুই উইকেট শিকার করেন র‍্যানকিন। এবং ইফতেখার আলী খান পতৌদির পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ইংল্যান্ডের পক্ষে এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলার কীর্তি গড়েন! র‍্যানকিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি কোর্টনি ওয়ালশ এবং গ্লেন ম্যাকগ্রাকে অনুসরণ করতেন। তাদের মতোই ব্যাটসম্যানকে লক্ষ্য করে বাউন্সার দেওয়াটা ম্যাচে তার মূল লক্ষ্য থাকত।

ইংল্যান্ডের হয়ে ১ টেস্ট, ৭ ওয়ানডে আর ২টি টি-টোয়েন্টি সহ মোট ১০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন র‍্যানকিন। আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ১১৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। র‍্যানকিন তার ১৩ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ৩ টেস্টে ৮ উইকেট, ৭৫ ওয়ানডেতে ১০৬ উইকেট ও ৫০ টি-টোয়েন্টিতে ৫৫ উইকেট শিকার করেন।

ঘরোয়া ক্রিকেটে ২৪৫ ম্যাচে শিকার করেছেন ৯৩৬ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পাঁচ উইকেটের দেখা না পেলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৯ বার শিকার করেছে পাঁচ উইকেট। ব্যাট হাতে উল্লেখ করবার মতো কিছুই করতে পারেননি তিনি। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আছে একটি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস।

আয়ারল্যান্ড দলে খেলা তাঁরই সতীর্থ ইয়ন মরগ্যান এখন ইংল্যান্ড দলের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের অধিনায়ক। আসলে সবার সব স্বপ্ন তো পূরণ হয়না। স্বপ্ন তো সবাই দেখেন। ক’জনেরই বা তা পূরণ হয়। তেমনিভাবে স্বপ্ন দেখেছিলেন র‍্যানকিনও। সুযোগ যে পাননি তাও কিন্তু নয়! কিন্তু ইনজুরি আর ফিটনেস সমস্যা তাকে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি চলতি বছর গত মে মাসের ২১ তারিখ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই পেসার।

ছিল প্রতিভা, ছিল সুযোগ! শুধু ছিল না ভাগ্য! এই ভাগ্যই তাকে যেতে দেয়নি সাফল্যের অন্তিম মঞ্চে। অথচ, তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি দু’টি ভিন্ন দেশের হয়ে তিনটি ফরম্যাটেই খেলেছেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link