এবারের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে চেক রিপাবলিক কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে। যদিও এবার তাদের খেলা দিয়ে দর্শকদের আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে। চেক ফরওয়ার্ড প্যাট্রিক শিক এখন পর্যন্ত যৌথভাবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাথে সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে অবস্থান করছেন। যদিও উভয়ের দলই ইতোমধ্যে ইউরোর আসর থেকে বিদায় নিয়েছে।
চেক রিপাবলিক বিশ্ব ফুটবলে এতটা বড় নাম নয়। মাঝে মাঝে মত কিছু ভাল পারফরম্যান্স দেখালেও এছাড়া তারা বলার মত কিছু করতে পারে নি। তবে ১৯৯২ সালের আগে দেশটির অন্য আরেক নাম ছিল, চেকোস্লোভাকিয়া। ১৯২০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত তারা চেকোস্লোভাকিয়া নামে খেলে এসেছে।
এবং সে সময়ের চেকোস্লোভাকিয়া সে সময়ের ফুটবল বিশ্বে বেশ সমীহ জাগানিয়া নাম ছিল। এই নামে তারা আটটি বিশ্বকাপ খেলেছে, যার মধ্যে ১৯৩৪ ও ’৬২ বিশ্বকাপে রানার্সআপ, এবং ১৯৭৬ সালের সে সময়ের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ঘরে তুলেছিল। তাছাড়া ১৯৮০ সালের অলিম্পিক ফুটবলে তাঁরা স্বর্ণপদক অর্জন করে।
চেকোস্লোভাকিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক জয়টিই বিশাল ব্যবধানের ছিল। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়াকে ১৯২০ অলিম্পিকে তারা ৭-০ ব্যবধানে হারায়। এবং তারা সেই অলিম্পিকের ফাইনালেও উঠে। তবে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ফাইনালটি নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তারা মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যায়, এবং পরবর্তীতে শাস্তি হিসেবে পদক বঞ্চিত হয় তাঁরা।
ইতিহাসের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ, ১৯৩৪ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়া অসাধারণ ফুটবল প্রদর্শন করে। কিন্তু এবারও তাদের ইতালির কাছে অতিরিক্ত সময়ের গোলে ২-১ এ হেরে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যদিও ৭১ তম মিনিটে তারাই প্রথম এগিয়ে গিয়েছিল। তবে এই বিশ্বকাপে তাদের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় অলড্রিচ নেজেডলি পাঁচ গোল করে সর্বোচ্চ গোলকারী ছিলেন।
১৯৩৮ বিশ্বকাপেও তারা ভালই খেলছিল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালের নক আউট পর্বে ব্রাজিলের সাথে প্রথম দিন ৯০ মিনিট শেষেও ১-১ গোলে ড্র থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা হওয়ার মত অবস্থা ছিল না, কারণ চেকোস্লোভাকিয়ার নেজেডলি সহ মূল অনেক খেলোয়াড় ই ইনজুরির কারণে খেলার অবস্থায় ছিলেন না।
এরপরে দু’দিন পর সেই অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে তারা ২-১ গোলে হেরে যায়। নানা ঘটন অঘটনের সেই ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব বুরডক্স’ নামে পরিচিত। এই ম্যাচেই বিশ্বকাপের ইতিহাসের ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রথম একাদশের তিন জন খেলোয়ারের বদলি হয়।
অনেকেই হয়ত জানেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেকোস্লোভাকিয়া তাদের নিজেদের নামে না খেলে বোহেমিয়া নামে কিছু আনঅফিশিয়াল ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুই বিশ্বকাপে তারা কোয়ালিফাই করতে পারেনি।
তবে ১৯৬২ বিশ্বকাপে তারা ব্রাজিল, স্পেন এর সাথে কঠিন গ্রুপে থেকেও শক্তিশালী ফুটবল খেলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এবং ফাইনালে জোসেফ মাসুপোস্টের গোলে প্রথমে এগিয়ে থেকেও ৩-১ ব্যবধানে ব্রাজিল এর কাছে হেরে যায়।
এরপর অবশ্য চেকোস্লোভাকিয়া ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপের পর যেন নিজেদের হারিয়ে খুজতে থাকে। ‘৬২ এরপর সাতটি বিশ্বকাপের মধ্যে মাত্র তিনটিতেই তাঁরা কোয়ালিফাই করতে পেরেছিল। দেশ ভাঙনের পূর্বে ৯০ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়া নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের মত একটু জ্বলে উঠে ১৯৯২ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি দেশে পরিণত হয়।
নতুন চেক রিপাবলিক প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৯৪ সালে তুরস্কের বিপক্ষে। এই নতুন দলটি আর আগের মত আর পরাক্রমশালী দল হয়ে উঠতে পারেনি। বলতে গেলে এখনো তারা তাদের পূর্বসূরীদের সফলতার ঢেঁকুর তুলছে। দেশভাগ এরপর এখন পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০০৪ এর ইউরো কাপ এর সেমিফাইনাল।
বিশ্ব ফুটবল ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গেলে কখনো কিছু হতাশা জেগে উঠে মনে। ফেরেঙ্ক পুসকাসের হাঙ্গেরি, ডি ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসের সম্পর্কে জানলেও যেমন মনের কোণে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস জমে আসে, হয়ত চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়ার মত দল গুলোর হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস শুনলেও তেমনটাই মনের কোণে উঁকি দেয়। হয়ত এই হলো বিধির বিধান।